চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাসাতো নয়, মিনি নির্বাচন অফিস!

রোহিঙ্গাদের ভুয়া এনআইডি তৈরি এনআইডি নিবন্ধনের সব ধরনের ডিভাইস ছিল সেই বাসাটিতে

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ৩:১৪ পূর্বাহ্ণ

অত্যন্ত ভদ্র-বিনয়ী ও মিষ্টিভাষী হিসেবে নির্বাচন অফিসে বেশ কদর ছিল মোস্তফা ফারুকের। বিশ্বাসের উপর ভর করে ভোটার নিবন্ধনের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামাদি তাকে সঁপে দেওয়া হতো। কিন্তু অতি ভদ্র যে চোরের লক্ষণ সেই প্রবাদটি নিজেই প্রমাণ করে দিলেন মোস্তফা। ভদ্রতার ছন্মাবরণে নিজের বাসাকে পরিণত করেছে ‘মিনি নির্বাচন অফিস’। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের সব ধরনের ডিভাইস বাসায় রয়েছে তার। যার মাধ্যমে জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বিঘেœ রোহিঙ্গাদের ভোটার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ধরা পড়ে তার ভয়ংকর রূপ।

শুধু মোস্তফা নয়, গ্রেপ্তার হওয়া ডবলমুরিং নির্বাচন অফিসের পিয়ন জয়নাল আবেদীনও তার বাসাকে নির্বাচন অফিস বানিয়ে রেখেছিল। নির্বাচন কমিশনের ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) জয়নালকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার স্বীকারোক্তি তার বাসা থেকে নির্বাচন কমিশনের একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন (শুক্র-শনিবার) জেলা নির্বাচন অফিস থেকে ডিএসএলআর ক্যামেরা, ফিঙ্গার প্রিন্ট, স্ক্যানার ও সিগনেচার প্যাড গোপনে বাসায় নিয়ে যেতেন জয়নাল। বাসায় বসেই এসব সরঞ্জাম দিয়ে রোহিঙ্গাদের তথ্য নিবন্ধন করে ঢাকায় সাগরের কাছে পাঠাতেন। নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় সার্ভারে ঢুকে তা আপলোড করতেন সাগর নামে ঢাকার এক অপারেটর। প্রতিটি রোহিঙ্গা ভোটারের জন্য ৫০-৬০ হাজার টাকা নিতেন জয়নাল। তবে জয়নাল স্বীকার করেছে, ওই ল্যাপটপ ১০ হাজার টাকা দিয়ে সাগর ও সত্য সুন্দরের কাছ থেকে কিনেছেন। ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন প্রকল্পে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন দুইজন। সেই সময় জয়নালের সঙ্গে পরিচয় তাদের।

জয়নালের চেয়ে আরও ভয়ংকর ছিল মোস্তফা ফারুক। মোস্তফা আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের অধীনে কাজ করতেন। নগরীর প্রতিটি থানা ও উপজেলায় ভোটার হালনাগাদ এবং এনআইডি কার্ড বিতরণের কাজ করতেন ফারুক। সেই সুবাদে সকল নির্বাচন কার্যালয়ের ল্যাপটপ ও মডেম এবং ভোটার নিবন্ধনের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি তার কাছে জমা থাকত। ২০১৪ সালে মিরসরাই উপজেলায় ভোটার হালনাগাদ কাজের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে যুক্ত হন তিনি। কাজ করার সময় ২০১৫ সালে তার হাত থেকে একটি ল্যাপটপ খোয়া গেলেও কোন হদিস করেনি নির্বাচন অফিস। সুচতুর ফারুক সকলের চোখে ধুলা দিয়ে ল্যাপটপটি নিজের কাছে রেখে দিয়ে খোয়া গেছে বলে জানায় নির্বাচন কমিশনে। কমিশনের লাইসেন্সধারী সেই ল্যাপটপ ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার করে আসছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে আসে।
টেকনিকেল সাপোর্ট মোস্তফা ফারুক জালিয়াতি কাজেও এক্সপার্ট। তার বাসা তো রীতিমতো নির্বাচন কার্যালয়। গ্রেপ্তারের পর তার হামজারবাগের বাসা থেকে দুইটি ল্যাপটপ, একটি মডেম, ১টি পেনড্রাইভ, ৩টি সিগন্যাচার প্যাড, আইডি কার্ডের লেমিনেটিং সরঞ্জাম ইত্যাদি উদ্ধার করেছে পুলিশ।

সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, ফারুকের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপটি নির্বাচন কমিশনের। কমিশনের এক টেকনিকেল এসিস্ট্যান্ট তা শনাক্ত করেছেন। তবে ল্যাপটপের তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। ধরা না পড়ে জন্য তথ্য মুছে ফেললেও পেনড্রাইভে রোহিঙ্গাদের অনেক তথ্য পেয়েছি। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক স্বীকার করেছে, কমিশনের বিভিন্ন অফিসে তার ‘এক্সেস’ ছিল। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কয়েকটা ধাপে রোহিঙ্গাদের আনা হতো। বাসায় রোহিঙ্গাদের ভোটার নিবন্ধন করা হতো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফারুক টেকনিকেল বিষয়ে খুবই পারদর্শী। ভোটার তালিকা হালনাগাদে সব কটি নির্বাচন কার্যালয়ের ভোটার সংক্রান্ত যাবতীয় মালামাল অনেকটা তার হেফাজতে থাকতো। তিনি আপলোড করতেন। সেই সুবাদে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা তার জন্য ছিল খুবই সহজ পথ।

জালিয়াতি চক্রের দুটি সিন্ডিকেট পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। জয়নাল নির্বাচন অফিসে সরঞ্জাম বাসা নিয়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করতো। আর ফারুক রীতিমতো বাসায় নির্বাচন কার্যালয় বানিয়ে ফেলেছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের সব ধরনের ডিভাইস রয়েছে তার কাছে। ভোটার করার সব ধরনের সরজ্ঞাম ছিল তার বাসায়। মোস্তফা এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত বলে জানান কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ।

২০১৪ সালে আউট সোর্সিং মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাজে যুক্ত হলেও জালিয়াতির কারণে দুইবার চাকরিচ্যুত হন ফারুক। তারপরও ২০১৮ সালে স্মাটকার্ড বিতরণকালে ডবলমুরিং থানা অফিসে টেকনিকেল সাপোর্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মোস্তফা ফারুক পরে নিজের এনআইডি পর্যন্ত বদলে ফেলে। মো. মোস্তফা নাম দিয়ে সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনে যুক্ত হন। জালিয়াতির অভিযোগে দুইবার চাকরিচ্যুত মোস্তফাকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় যুক্ত করা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। যার উত্তর এখনো মিলেনি। সর্বশেষ বোয়ালখালী ও সন্দ্বীপ উপজেলায় হালনাগাদ কাজে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট