চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিসার বিষক্রিয়ায় ভয়াবহ প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে শিশুরা

অনলাইন ডেস্ক

১৩ নভেম্বর, ২০২২ | ১১:১৮ অপরাহ্ণ

বাগেরহাটের বাসিন্দা অনিকের বয়স আট বছর। তবে বয়সের তুলনায় মানসিক বিকাশ ঘটেনি তার। অন্য স্বাভাবিক শিশুদের মতো লেখাপড়া করে না সে। সবকিছুই ভুলে যায়। এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান অনিকের মা শারমীন আকতার। পরীক্ষা করে দেখা যায়, তার রক্তে সিসার পরিমাণ ছিল ২৬ শতাংশেরও বেশি। চিকিৎসকরা জানান, মাত্রাতিরিক্ত সিসার বিষক্রিয়ায় শিশুটির এসব সমস্যা তৈরি হয়েছে।

অনিকের মা জানান, নিকটাত্মীয়ের পরামর্শে বাড়ির পাশের জমিতে একটি ব্যাটারি থেকে সিসা বের করার কারখানা স্থাপন করে সে। এ কারখানার সিসা অনিকের শরীরের প্রবেশ করেছে। ছেলের এমন পরিণতি দেখে এরই মধ্যে কারখানাটি বন্ধ করা হয়েছে। তবে সিসার বিষক্রিয়ায় এখনও প্রতিনিয়ত নানা সমস্যায় ভুগছে সে।

 

অনিকের মতোই সিসার বিষক্রিয়ার প্রভাবে প্রতিবন্ধিতার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। দেশে সাড়ে ৩ কোটি শিশু বর্তমানে সিসার বিষক্রিয়ার শিকার।

গবেষণকরা বলছেন, সিসা একটি স্লো পয়জনিং বা ধীরগতির বিষক্রিয়া। এটা দীর্ঘদিন শরীরে অবস্থান করলে বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো করে দেয়। শিশুদের ক্ষেত্রে সিসা প্রথমেই মস্তিস্কে আক্রমণ করে। এটা শিশুর শরীর ও শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। বয়স্ক লোকরাও একইভাবে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন আক্রান্ত থাকলে হৃদপিন্ড, যকৃৎ, পরিপাক ও প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি হয়। ফলে মাথা ঘোরানো ও গ্রন্থিতে ব্যথা দেখা দেয়। এক সময় প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে। এমনকি এর প্রভাবে মৃত্যুও হয়। দেশে বছরে সিসা বিষক্রিয়ায় ৩১ হাজার মানুষ মারা যায়।

 

চিকিৎসকরা বলছেন, সিসা কারও শরীরে একবার ঢুকলে ২০ বছর অবস্থান করে। তবে প্রাথমিক পর্যায়েই এটি শনাক্তের ব্যবস্থা দেশে নেই। সিসা রক্তে চলে গেলে এটি বাইরে আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এর চিকিৎসাও হয়ে পড়ে অনেক ব্যয়বহুল। তাই এটি প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়েই সিসা শনাক্তে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবে বর্তমানে দেশে মাত্র তিনটি সেন্টারে সিসা শনাক্তের ব্যবস্থা রয়েছে।

সিসা শিশুদের শরীরে কী প্রভাব ফেলছে তা দেখতে সিসাযুক্ত শিশু ও সীসামুক্ত শিশুদের নিয়ে সাতটি দেশে গবেষণা করেছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ১ হাজার ৩০০ শিশুর ওপর পরিচালিত এই গবেষণার ইতি টানা হয় ২০১৮ সালে। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী এসব শিশুর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের শরীরে সিসা ছিল না ভবিষ্যতে তাদের শিক্ষা, ভালো চাকরি, আয় সিসাযুক্ত শিশুদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ছিল।

 

বিশ্বব্যাংক বলছে, বিশ্বের মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সিসার বিষক্রিয়ায় শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ঘাটতির ফলে মানবসম্পদের নিম্নমুখী উৎপাদনশীলতা দেখা যাচ্ছে। এতে বছরে ৯৭৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
সম্প্রতি সরকারের আইইডিসিআর পরিচালিত ‘লেড পয়জনিং ইন বাংলাদেশ, রিসার্চ এভিডেন্স ফর আর্জেন্ট অ্যাকশন’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সাড়ে তিন কোটি শিশু সিসা বিষক্রিয়ার শিকার। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিশুরই রক্তে সিসার মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি নির্ধারিত মাত্রার (৩ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রামের) চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ২৪ থেকে ৪৮ মাস বয়সী শিশুদের শতভাগের শরীরেই সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

 

সম্প্রতি আইসিডিডিআর,বির একটি গবেষণায় ঢাকার ৫০০ শিশুর রক্ত পরীক্ষায় সবার শরীরেই সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বাজারের বিভিন্ন পণ্য পরীক্ষা করে ৩৬৭টি পণ্যের মধ্যে ৯৬টিতে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী ও খুলনা শহরে স্থানীয়ভাবে তৈরি খেলনা, রং, অ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের হাঁড়িপাতিল, সবজি, চাল ও মসলার নমুনায় সিসার উপস্থিত পাওয়া যায়।
এ ছাড়া মাটি, ছাই, পোড়া মাটি ও হলুদের গুঁড়ায় সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, সিসায় দূষিত হলুদের গুঁড়া গর্ভবতী নারীর শরীরে এর উচ্চমাত্রার উপস্থিতির কারণ। পল্লি এলাকায় পরীক্ষা করা ৩০ শতাংশ গর্ভবতী নারীর শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

আইসিডিডিআর,বি সিসা নিয়ে গবেষণার সমন্বয়ক মাহবুবুর রহমান বলেন, খাবার, শ্বাসপ্রশ্বাস ও গর্ভবতী মায়ের মাধ্যমে শিশুদের দেহে সিসা প্রবেশ করে।

সিসা ঝুঁকির জায়গাগুলো চিহ্নিত করে তা রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। মসলা, খাদ্যদ্রব্য ও গহনায় সিসার ব্যবহার বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সিসা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে একটি বড় গবেষণা ও ক্যাম্পেইন খুবই জরুরি।
ঢাকার পরিবেশবাদী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, দেশে সিসা বিষক্রিয়ার থেকে শিশুদের বাঁচতে সম্মিলিত কোনো উদ্যোগ নেই। শরীরে সিসার দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতিতে শিশুদের প্রতিবন্ধিতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। এটি এড়াতে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তে জোর দিতে হবে।

 

ইউনিসেফের পরামর্শক (হেলথ সেকশন) দিদারুল আলম বলেন, সিসাদূষণে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। অতীতে সিসার ব্যবহার কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশে ও বৈশ্বিকভাবে সিসার ব্যবহার বাড়ছে। রক্তে এটি ছয় থেকে সাত সপ্তাহ অবস্থান করে। সিসা মূলত আমাদের হাড় ও দাঁতে জমা হয়। যেখানে এটি ২০ থেকে ৩০ বছর থাকতে পারে।

সিসাযুক্ত জ্বালানি, রং ও পানি সরবরাহের পাইপ থেকে সিসাদূষণ ঘটতে পারে। ধনে, হলুদ, মরিচ এ ধরনের মসলার মধ্যে সিসার উপাদান পাওয়া গেছে। কম দামের কিছু গহনা, সুরমা, কাজল, সিঁদুর ইত্যাদিতেও সিসা পাওয়া যাচ্ছে। পুরোনো ব্যাটারির সিসা বের করে পুনরায় ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। দেশে পুরোনো ব্যাটারি সিসার একটি বড় উৎস।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসি লাইন ডিরেক্টর রোবেদ আমিন বলেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রায় সবকিছুর সঙ্গেই সিসা রয়েছে। ফলে শিশুরা এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী অনেক শিশু রয়েছে। এর সঙ্গে রক্তে সিসার মাত্রার সম্পর্ক যাচাই করা দরকার। মানব শরীরে সিসাদূষণ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো সুনির্দিষ্ট গবেষণা নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিসাদূষণের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। আমাদের দেশে সিসাদূষণ ব্যবস্থাপনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধু এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করে। বাকি কাজগুলো অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের। তবে এই কাজে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। তথ্যসূত্র: সমকাল

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট