চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হেমাঙ্গ বিশ্বাস গণসঙ্গীত ও নাট্যান্দোলনের প্রাণপুরুষ

কামাল আহমেদ

২৯ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

ভারতবর্ষে আধুনিক বাংলা গণসঙ্গীতের পথিকৃৎ বলা চলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলা গণসঙ্গীত ও নাট্যান্দোলনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জোয়ার আসে হবিগঞ্জের মিরাশী গ্রামের সূর্যসন্তান হেমাঙ্গ বিশ্বাসের হাত ধরে। তাঁর সময়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। শত শত গণসঙ্গীত রচনা করে, গেয়ে ও সুর দিয়ে সে আন্দোলনের আগুনে অক্সিজেন দিলেন এই কীর্তিপুরুষ। তিনি একাধারে বাংলা গণসঙ্গীতের কথা ও সুরের স্রষ্টা, এমনকি শিল্পীও। বিভিন্ন বিদেশি ভাষা ও সুরেও গানের সৃষ্টি করেছেন তিনি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম ১৪ ডিসেম্বর, ১৯১২ সাল ও মৃত্যু ২২ নভেম্বর, ১৯৮৭ সাল। তাঁর পিতার নাম হরকুমার বিশ্বাস ও মাতা সরোজিনী। তিনি একজন বাঙালি ও অসমিয়া সঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার। মূলত লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্রকরে গণসঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য।

হেমাঙ্গ বিশ্বাস ১৯৩০ সালে হবিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে থাকতেই যোগ দেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। লবণ আন্দোলনের সময় তাঁর ৬ মাস জেল হয় এবং ১৯৩২ সালে পুনরায় গ্রেফতার হওয়ার পর ২ বছর ৬ মাস সাজা হয়। ১৯৩৮ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৩০ সাল থেকেই তিনি কংগ্রেসের ভলান্টিয়ার হিসেবে হবিগঞ্জে রোহিনীরায় গ্রুপের মূখ্য গায়ক ছিলেন। ১৯৪২ সালের ১৮ জুলাই তারিখে সিলেট টাউনের গোবিন্দচরণ পার্কে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে সুরমাভ্যালী কালচারাল স্কোয়াড গঠিত হয়। এই স্কোয়াড নিয়ে তিনি ১৯৪৫ সালে সারা আসাম পরিভ্রমণ করেন এবং কুশল কুমারের ফাঁসী, কেবিনেট মিশনের কার্টুন নৃত্য, দুর্ভিক্ষ নৃত্য, নৌ বিদ্রোহের উপর গানের অনুষ্ঠান ও ছায়ানাটক ইত্যাদি পরিবেশন করেন।
তাঁর মূল কর্মক্ষেত্র ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গন। সিলেটে তিনি তরুণ সংঘের সদস্যদের কাছে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে জেলে ও চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় নানা বইপত্র পড়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন। ১৯৩০ সাল থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস কংগ্রেসের ভলান্টিয়ার হিসেবে মিছিল শোভাযাত্রা ইত্যাদিতে গান গাইতেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শের জন্য পিতা কর্তৃক বাড়ি থেকে বিতাড়িত হলে হেমাঙ্গ বিশ্বাস শিলং চলে যান এবং পার্টির পক্ষ থেকে গ্রামাঞ্চলে সংগঠনের কাজে নিযুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারদল হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সুরমাভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড। এই স্কোয়াড নিয়ে তিনি শহরে শহরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রচার করতেন।

১৯৪৬ সালে তিনি নির্বাচিত হন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আসাম প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক। তিনি বিভিন্ন নাটক, চলচ্চিত্র ও যাত্রায় সংগীত পরিচালনা করেছেন, যার মধ্যে কল্লোল, তীর, তেলেঙ্গানা, ১৭৯৯, লাল লণ্ঠন, লেলিন, পদ্মানদীর মাঝি, বিদুন, রাইফেল, রাহুমুক্ত রাশিয়া, মানুষের অধিকারে, কাঙ্গাল হরিশচন্দ্র অন্যতম। ১৯৮৩ সালে তিনি গানের দল নিয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং ঢাকা ও সিলেটে অনুষ্ঠান করে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে গান্ধীর মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষ বসু। সুভাষ বসুর প্রতি গান্ধির বিরাগজনিত কারণে সুভাষ বসু ১৯৩৯ সালের ১৯ এপ্রিল কংগ্রেসের সভাপতির পদে ইস্তফা দেন। সুভাষ বসু বাংলার বাম রাজনীতিকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৩৯ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস তাঁর সফরের এক পর্যায়ে আসেন সিলেটে। ঐ সময় তিনি সফর করেন হবিগঞ্জ। হবিগঞ্জে তিনি উঠেন ডা. নরেন রায়ের বাড়িতে এবং সেখানে একটি ঘরোয়া বৈঠক হয়। হবিগঞ্জের কর্মীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন একমাত্র হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ১৯৩৯ সালে হবিগঞ্জ শহরে বামপন্থি কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে নিখিল মিত্র, কুমুদানন্দ ভট্টাচার্য, ডা. গোপেশ বিশ্বাস, প্রাণেশ বিশ্বাস, চুনী নাগ, বেনু নাগও ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। প-িত জহরলাল নেহেরুও এসেছিলেন হবিগঞ্জে। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে তিনি সফর করেন সুরমা উপত্যকা।
শেখ ফজলে এলাহীর হবিগঞ্জের রাজনৈতিক ইতিহাস গ্রন্থে প্রাপ্ত তথ্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নিজের বর্ণনায় তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের ও তাঁর নিজের সম্পর্কে কিছু কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন- ‘হবিগঞ্জে হঠাৎ এলো এক আন্দোলনের জোয়ার-আইন আদালতের শহরে উঠলো আইন অমান্যের ঢেউ।’ হবিগঞ্জের এই আন্দোলনের রূপকার কংগ্রেস নেতা শিবেন্দ্র চন্দ্র ও সুরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস।

অসহযোগ আন্দোলনের হবিগঞ্জের একটা চাক্ষুষ বর্ণনা পাওয়া যায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জবানিতে: শুরু হল লবণ সত্যাগ্রহ। আইন ভেঙে লবণ তৈরির শপথ নেওয়া হলো মেদিনীপুরের কাঁথি নোয়খালীর সমুদ্র তীরে। তারপর ডান্ডি মার্চ। সিলেট থেকে বিধুভূষণ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি দল নোয়াখালী যাত্রার পথে হবিগঞ্জ এল। আমরা তাঁদের বিপুল সংবর্ধনা জানালাম। সেই সময়ে হবিগঞ্জের মোক্তার রোহিনী রায় (আমরা যাকে হরিবাবু বলে ডাকতাম) একটি গান রচনা করেন যা সারা পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল। গোষ্ঠবিহারী দাস চৌধুরী ও আমি মিলে বহু মিছিলে এটা গেয়েছি। গানের কিছু অংশ মনে আছে।
গান্ধি সজ্জিত বিরাট বাহিনী
নির্ভয়ে চলিছে বাঁধা নাহি জানি,
ভারতের মুক্তি কাম্য আমাদের
এসো এসো সৈনিক ডাকিছে সেনানী।।
লবণ শুল্ক করগো ভঙ্গ
ছেড়ে দাও আমোদ, ছেড়ে দাও রঙ্গ,
অহিংস ধর্মে আচ্ছাদি অঙ্গ
দাওগো সাজায়ে জননী, ভগিনী ।।

হেমাঙ্গ বিশ্বাস আরো লিখেন, ‘মিছিলের সুর ও স্টাইল ক্রমশ বদলে যেতে লাগল। এই প্রথম গৃহবধূরা মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে মিছিলে যোগ দিলেন। “না জাগিলে ভারত ললনা/ এ ভারত আর জাগে না, জাগে না”- ললনাদের সংখ্যা যতই বাড়তে লাগলো রাস্তার পাশের দর্শকদের ঔৎসুক্যও ততই বাড়তে লাগল। কে কোন বাড়ির বউ তা নিয়ে একটা গবেষনা চলত। আন্দোলনের হাওয়া বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ঘোমটাও উপরে উঠতে লাগল; মুখগুলো স্পষ্ট দেখা গেল। শ্রীমতি সুমতি নাগ, সুখদা সুন্দরী পাল চৌধুরী, শোভনবালা দেব প্রমুখরা কেবল মাথার ঘোমটা সরালেন না; জনসভায়, বক্তৃতার মঞ্চেও তাদের দেখা যেতে লাগল। সুমতিনাগ একজন উঁচুদরের বক্তা হয়ে উঠেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাগৃতি ও মুক্তি আন্দোলন সামন্তীয় সমাজ বন্ধনকে শিথিল করে দিল। মনে আছে আজমিরী গঞ্জ থেকে তিনজন গণিকা এসে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন এবং এদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হবিগঞ্জের কবিগানের শ্রেষ্ঠ শিল্পী কুমুদিনী।
১৯৩৮-৩৯ সালে বিনয় রায়, নিরঞ্জন সেন, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখের সাথে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আই পি টি এ গঠন করেন। পঞ্চাশের দশকে এই সংঘের শেষ অবধি তিনি এর সাথে ঘনিষ্ট ভাবে যুক্ত ছিলেন। এর আগে ১৯৩৫ সালে তিনি কারাবন্দি থাকাকালে যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। তারপর যাদবপুর হাসপাতালে কিছুকাল চিকিৎসাধীন থাকেন এবং সেই কারনে তিনি মুক্তি পান। ১৯৪৮ সালে তিনি তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সময়ে গ্রেফতার হন এবং তিন বছর বন্দি থাকেন।

১৯৪২ সালে বাংলার প্রগতিশীল লেখক শিল্পীদের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম কলকাতায় আসেন সংগীত পরিবেশন করতে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে এবং জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়ালের সহযোগিতায় সিলেট গণনাট্য সংঘ তৈরি হয়। স্বাধীনতার আগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গানের সুরকারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান। সেই সময়ে তাঁর গান- “তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান, কিষাণ ভাই তোর সোনার ধানে বর্গী নামে” প্রভৃতি আসাম ও বাংলায় সাড়া ফেলেছিল। আসামে তাঁর সহযোগী ছিলেন বিনোদবিহারী চক্রবর্তী, সাহিত্যিক অশোক বিজয় রাহা, সেতারবাদক কুমুদ গোস্বামী প্রভৃতি। ১৯৫৬ সালে তিনি চিকিৎসার জন্য চীনে যান। আড়াই বছর সেখানে খুব কাছে থেকে দেখেন চীনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ১৯৬১ সালে স্থায়ীভাবে চলে আসেন কলকাতায় এবং সেই সময়েই চাকুরি নেন সোভিয়েত কনস্যুলেটের ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে। চীন- ভারত মৈত্রীর ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনি দু’বার চীনে গিয়েছেন। চীনা ভাষায় তাঁর অনেক গান আছে। ১৯৭১ সালে মাস সিঙ্গার্স নামে নিজের দল গঠন করে জীবনের শেষ দিকেও তিনি গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেরিয়েছেন । তিনি কল্লোল, তীর, লাল লণ্ঠন প্রভৃতি নাটকের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। লাল লণ্ঠন নাটকে তিনি বিভিন্ন চীনা সুর ব্যবহার করেছিলেন। রাশিয়ান গানও অনুবাদ করেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগীত ‘ইন্টারন্যাশনাল’ ও রাশিয়ান সুরে তার গাওয়া “ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার তুফান” গানটি “ওহ ঃযব পধষষ ড়ভ পড়সৎধফব খবহরহ”-এর ভাবানুবাদ। এটি কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছে অতীব জনপ্রিয় হয়।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা হলো : শঙ্খচিলের গান, জন হেনরীর গান, মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য, বাঁচব বাঁচব রে আমরা, মশাল জ্বালো, সেলাম চাচা, আমি যে দেখেছি সেই দেশ প্রভৃতি।

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান ও শঙ্খচিলের গান তাঁর গানের সংকলন। বাংলা ও অসমিয়া ভাষায় তাঁর লিখিত গ্রন্থ লোকসংগীত শিক্ষা। এছাড়াও কুল খুরার চোতাল, আকৌ চীন চাই আহিলো, জীবন শিল্পী জ্যোতিপ্রসাদ, লোকসংগীত সমীক্ষা বাংলা ও আসাম, উজান গাঙ বাইয়া, হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনাবলী (প্রকাশক : অসম প্রকাশন পরিষদ) সন ২০০৮ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। পঞ্চাশের দশকে তাঁর গানে দেশ বিভাগের যন্ত্রণার পাশাপাশি সংগ্রামের কঠিন শপথে উদ্দীপ্ত হওয়া যায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি লিখলেন, শোন দেশের ভাই ভগিনী শোন আচানক কাহিনী, কাঁদো বাংলা জননী। ১৯৬৫ সালে অনুবাদ করেন ‘আমরা করবো জয়’- মার্কিন লোকসংগীত শিল্পী পিট সিগারের গাওয়া সেই জনপ্রিয় গানটি- “বি ংযবষষ ড়াবৎ পড়সব”।

তিনি গণসংগীত গেয়ে যেভাবে আন্দোলন করতেন এবং সাধারণ মানুষদের নিজ অধিকার সম্পর্কে উজ্জীবিত করতেন, সেটা আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়। গণসংগীত যে আন্দোলনের শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে, সেটা আমরা ৪৭-এর স্বাধীনতা আন্দোলন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার সরকার পতনের আন্দোলন থেকেই উপলব্ধি করেছি। এই গণসংগীতের একজন মুকুটবিহীন সম্রাট ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তিনি ১৯৮৭ সালের ২২ নভেম্বর কলকাতার একটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট