চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

মা অজান্তেই চোখের জল মোছেন

দীপান্বিতা চৌধুরী

৪ জুলাই, ২০২৩ | ১২:১৬ অপরাহ্ণ

হারাই হারাই ভয়ে গো তাই বুকে চেপে রাখতে যে চাই/কেঁদে মরি একটু সরে দাঁড়ালে-/জানি না কোন্ মায়ায় ফেঁদে বিশ্বের ধন রাখবো বেঁধে/আমার এ ক্ষীণ বাহু দুটির আড়ালে। (জন্মকথা)- কবিগুরু

 

সব মা-ই তার সন্তানকে মায়ার ডোরে চিরদিন বেঁধে রাখতে চায়। কিন্তু একদিন সে বিশ্বের ধন হয়ে যায়। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মায়ের ক্ষীণ বাহুর বন্ধনকে ছিন্ন করতে চায়। মা-তো চিরকাল তার সন্তানকে ছোট্টবেলার সেই ছোট্ট খোকাটির মতোই অপরিসীম স্নেহ-বন্ধনে বেঁধে রাখতে চায়। কিন্তু অকৃতজ্ঞ সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে,বাড়ি-গাড়ি, সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে মা’কে ভুলে যায়। যে মা হাজার প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, নিজের বুকের রক্ত দিয়ে, নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়ে বড় করে তুলল। প্রতিদান মা আশা করেন না, মায়ের ঋণ শোধ করা যায় না কোন কিছুর বিনিময়েই। মা শুধু চান ছেলে তার সান্নিধ্যে থাক, চিরকাল তার ছোট্ট শিশুটির মতোই তার স্নেহ-ক্ষুধাকে পরিতৃপ্ত করুক। ছেলে সেটা করা তো দূরের কথা, মায়ের অস্তিত্বকেই যেন অস্বীকার করতে চায়। নিজের সংকীর্ণ, স্বার্থপর দুনিয়ায় মা’কে সে ঠাঁই দিতে চায় না। বৃদ্ধা মা আরো অসহায় হয়ে পড়ে স্বামী হারা হয়ে পড়লে, নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে সে তখন সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। চায় ছেলে-বউ, নাতি-নাতনি পরিবৃত ভরন্ত সংসারের স্বাদ, প্রিয় বা কাছের মানুষটিকে হারানোর বেদনা ও নৈরাশ্যকে মা এভাবেই ভুলতে চান। সন্তানের নির্ভরশীল বাহু তাকে স্বামীর প্রতি নির্ভরতার পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়। নাতির শৈশবের সঙ্গী হয়ে সন্তানের শৈশব তিনি ফিরে পান।

 

নতুন প্রজন্ম ও ঠাকুরমার সান্নিধ্য উপভোগ করে, যা তাকে পরবর্তী জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করে। কিন্তু মায়ের সে আশা পূর্ণ হয় না। ছেলে নিজের ছোট্ট সুখী সংসারে মা’কে বোঝা মনে করে, চূড়ান্ত অবহেলার শিকার হন অসহায় বৃদ্ধা। যদিওবা ঠাঁই হয় তবে পড়ে থাকতে হয় এককোণে। হয়তো অর্থ, পার্থিব সুখ কোনো কিছুর-ই অভাব থাকে না ছেলের সংসারে ছেলে। বউয়ের হাসিমুখে একটু কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসার, তাকে একটু সঙ্গ দেওয়ার। দিনশেষে মায়ের কাছে বসে তার ছোট্ট বেলার মধুরস্মৃতি রোমন্থন করে মা’কে মনে করিয়ে দেওয়া আমি তার ছোট্ট খোকাটিই আছি। মায়ের কোলে মাথা রেখে চুলে বিলি কেটে দেবার আবদার, নাতি-নাতনিদের রূপকথার গল্প শোনার আবদার। বৌমার একটু স্নেহ-শ্রদ্ধার দৃষ্টি-ব্যাস্ এই তো মায়ের ক্ষুদ্র চাওয়া। যা তার বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ জীবনকে ভরিয়ে দিতে পারে পূর্ণতায়।

 

কিন্তু মা তা পায় না, অবহেলার জীবন সহ্য করতে করতে একদিন মা’কে ছেলের কাছে শুনতে হয়-মা, তোমার নিশ্চয়ই বড় একা লাগে, আমরা তোমাকে সময় দিতে পারি না। তার চেয়ে বরং ভালো একটা বৃদ্ধাশ্রমে তোমাকে রেখে আসি, কি বলো? সেখানে তোমার সমবয়সী অনেকের সঙ্গ পাবে। না, তোমার কোন অভাব রাখবো না, সব থেকে লাক্সারি বৃদ্ধাশ্রমেই তোমাকে রাখবো। আদর যত্মের কোন ত্রূটি হবে না। আমরাও সময় পেলে তোমাকে দেখে আসবো। মা আর কি করেন, ছেলের সুবিধাই তার সুবিধা। অজান্তেই চোখের জল মোছেন। নাতিটার গায়ে হাত বুলিয়ে একটু আত্মীয়তার উষ্ণতা খুঁজতে চেষ্টা করেন। চোখের সামনে ভাসে গ্ৰামের সেই শ্বশুরের ভিটে, আম-কাঁঠালের স্নিগ্ধ ছায়া ঘেরা আঙিনা, যেখানে নববধূ হয়ে তিনি পা রেখেছিলেন। সেই ভালোবাসা-পাগল মানুষটি, প্রথম মা হওয়ার আনন্দ। খোকার শৈশব, সেই উঠানে তার হাঁটি হাঁটি পা পা- তার আঙুল ধরে প্রথম চলতে শেখা, ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন- খোকা, আমাকে গ্ৰামের বাড়িতে রেখে আসবি? ছেলে বলে- না, ওখানে তোমাকে দেখবে কে? শেষে তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে গ্ৰামের লোক আমাকে দুষবে! অসহায় শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধা, বলতে চেষ্টা করেন যে কদিন বাঁচি, ঐ মধুর স্মৃতি ভরা আঙিনাতেই বাঁচতে চাই। কিন্তু বলতে পারেন না, বুকভরা দীর্ঘশ্বাস, আর চোখের জল নিয়ে ছেলে তাকে রেখে আসে বৃদ্ধাশ্রমে।

 

এরপরও মায়ের আশা মরতে চায় না- ভাবেন, তাকে ছাড়া নিশ্চয়ই ছেলের ফাঁকা লাগবে। নাতিটা নিশ্চয় বায়না করবে, ছেলে তাকে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। বৃদ্ধাশ্রমে কে কাকে সঙ্গ দেবে! সব আবাসিক বৃদ্ধারাই ছেড়ে আসা নাতি-নাতনির দুঃখে চোখের জল ফেলে। ভালো লাগে না, কিচ্ছু ভালো লাগে না মায়ের। জানালার ধারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন- ঐ বুঝি খোকা তাকে নিতে এলো। টিনের তোরঙ্গে ছেলের বাচ্চা বয়সের খেলনা গুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। বড় যত্ম করে তিনি এগুলিকে রেখেছেন, সাধ ছিল নাতিকে এগুলি দেখিয়ে তাক্ লাগিয়ে দেবেন! এই খেলনা গুলির মধ্যে তিনি ফিরে পেতে চান খোকার শৈশবের মাতৃটান। এখন সেই ছোট্ট খোকার স্মৃতি-ই তার বড় আপন। বড় খোকা হারিয়ে গেছে তার উচ্চাশার জগতে, সেখানে তার মায়ের স্থান কোথাও নেই। বৃদ্ধা মা, অসহায় ফ্যালফেলে দৃষ্টি নিয়ে সেই ছোট্ট খোকাকে দেখতে পান, যে মল পরা টলোমলো পায়ে, মুখে আধো-আধো মা ডাক নিয়ে বসে আছে শৈশবের আঙিনায়। মা আকুল আগ্ৰহে তাকিয়ে থাকেন, যেন বলতে চান- আয় বাছা বুকে আয়, শূন্য বুকটা একটু জুড়াই!

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট