চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

কবি সাঈদুল আরেফীনের বিচিত্র স্বাদের কাব্যগ্রন্থ আদিম আলো

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু

৩১ জানুয়ারি, ২০২০ | ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

আদিম আলো
সাঈদুল আরেফীন
প্রকাশক: বেহুলাবাংলা, ঢাকা
প্রকাশকাল:ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রচ্ছদ: আল নোমান
মূল্য: ১৭৫ টাকা

‘খোলাকাশের মধ্যিখানে অন্যরূপে নাগরিক জলছবি এক
ভেসে আছি, নগরের কোলাহলে প্রিয়তম কবিতার খেলায়।’
ভেসে আছি আমরাও, মানে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, পাঠক বাস করছি খোলাকাশের নিচে, কিন্তু ভেবে দেখা হয়নি এমনতর করে। কিংবা কবিতার খেলায় মেতে ওঠা হয়নি। হয়তো বা মেতে উঠি নিজের অজান্তে। সেই দিকটিকেই প্রকাশ্যে চিরচেনার জগৎকে চেনালেন কবি সাঈদুল আরেফীন ‘ভেসে আছি কবিতায়’ শিরোনামে এমন বর্ণনা করে।
কবি সাঈদুল আরেফীনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আদিম আলো’ আমাদের নানামুখী বিচিত্র স্বাদ এনে দেয়। আবার বেশ আবেগে-স্বপ্নে বিভোর করে রাখে। মোট ৫৫টি কবিতার সম্ভার ‘আদিম আলো’। কেন জানি, কবিতার পড়লেই কবিতার সাথে একাত্ম হয়ে নিজের সাথে মেলাতে শুরু করি। বাঙালি তো! বড় আবেগপ্রবণ। তাই কবিতার পরিবেশ, চরিত্র, ভাবনাÑ কখন জানি নিজের হয়ে ওঠে। কবির ভাষা নিজের ভাষা হয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে। এখানেই কবির পটুতা।
বিশিষ্ট কবি স্বপন দত্ত এই সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, “কবিতা প্রকৃতপক্ষে, পাঠককে নিজেদেরই আবিষ্কার করতে প্রাণিত করে।” তাই বোধ করি ‘জলজোছনায় রাত’ শীর্ষক কবিতায় (পৃঃ ৪৯) রাতের বর্ণনা পাঠকের ভাবনার সাথে মিলে যায় এভাবে-
‘বর্ণিল রাতের ব্যালকনিতে লক্ষকোটি তারায় তারায় সিক্ত প্রেম যমুনার জলঝোছনা
তোমায় আমায় গড়ে দেবে জন্ম-জন্মান্তরের অনুপম রাতময় এক গল্প।’
… কবির এমন কল্পনার সাথে পাঠকরে মন কি আন্দোলিত হয় না? অদৃশ্য প্রেম কিংবা প্ল্যাটোনিক প্রেমের ভাবনাকে একবারের জন্যও কি উসকে দেয় না? হয়তো দেয়। যা একান্ত ভুবনে বিচরণ করে থাকে। হয়তো বা প্রকাশ্যে বলতে পারে না। কবি বলে দেয়। তাই একজন কবিকে দার্শনিকও বলা যায়। যেহেতু, কবি সাধারণ মানুষের ভাবনাকে-চিন্তাকে বুঝতে পারেন। মনের আকাক্সক্ষাকে জানেন। দেশ ও পরিবেশ পরিস্থিতিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। এই কারণেই একজন কবির কবিতা হয়ে ওঠে সর্বজনীন। পড়তে ভাল লাগে কবিতা। নিজের হয়ে ওঠে কবিতার বিষয়।
কবি সাঈদুল আরেফীনের কাব্য ভাবনায় অনেক কিছু আছে। মানুষ আছে। দেশ আছে। জনতা আছে। পরিবেশ আছে। আসলে, এসবের বাইরে তো নয় মানুষ। সুতরাং, কবির কাব্যজগত বেড়ে উঠেছে এসব ঘিরে। যেখানে সাধারণ মানুষও ভেবেছে। কিন্তু প্রকাশটা করা হয়ে ওঠেনি। কবি করে দিয়েছে। তাই এই ‘আদিম আলো’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠকের প্রিয় হয়ে উঠতে পারে। একটা সময়ে যখন দেশজুড়ে চলছিল পেট্রোল বোমার মহোৎসব, সেই পর্যবেক্ষণে কবি সাঈদুল লিখছেনÑ
‘নগরে বন্দরে পেট্রোল বোমাতংকে কাঁপে স্বাধীনতা
কাঁপে কান্নায় ক্ষোভে ক্রোধে নীরব নিথর
সাধারণ জনতার ভিড়ে।’
(মুক্তিসেনার ত্রিমাত্রিক যাত্রা, পৃঃ৪১)
তাই বলে কবিরা কখনো হতাশায় থাকেন না। আশার আলো জাগাতে পারেন। স্বপ্নের বীজ বুনতে পারেন। পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারেন। তেমনি আরেকটি কবিতাÑ
‘ এখনো পাই প্রতিচ্ছবি রক্ত আখর একাত্তর, আন্দোলনমুখর
বিজয়ের বার্তা মাটির ঘ্রাণে, মাটিতেই প্রাণ
তোমাতেই দেখি স্বপ্ন একুশ নতুন উদ্দীপনায়।’
(একুশেই স্বপ্ন, পৃঃ ১৪)
এমনভাবেই প্রেরণার উৎস খুঁজে দেখেছেন কবি নিজের বৃত্তের মধ্যেই। এই বৃত্ত স্বদেশ। তিনি লিখেছেনÑ
‘জয়বাংলা কিংবা আমার সোনার বাংলার প্রকৃত সুর
রং ছড়াবে আর রং ছড়াবে
জীবনমুখী গানে স্বপ্নিত আগামী এক বাংলাদেশে।’
(জীবনমুখী গান: পৃঃ ৪৩)
এমনভাবেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর করুণ বিদায়ের মাঝে খুঁজেছেন কবি সাঈদুল নির্ভরতাÑ
‘জেগে আছে বাংলাদেশ শতাব্দীর
প্রান্তে মুজিব দেদীপ্যমান তোমার দুরন্ত বাঙালিয়ানা গিমাডাঙ্গার
বুক চিরে লক্ষ কোটি কিশোরেরও নও,
তুমি এক অভিন্ন মানবতাবাদী শ্রেষ্ঠ মহান পুরাণ
অম্লান চির উন্নত শোণিত ধারায় বয়ে যাও আবহমান।’
(সকালে না ফোটা আলোয় দেখা, পৃঃ ৪৫)
সময়ের আবর্তনে কবিতা চলেছে নিত্য নতুন ধারায়। বিচিত্রিতায়। সময়ে-প্রয়োজনে কবিতা হয়ে উঠেছে মানুষের মনের খোরাক। কখনো প্রতিবাদী। কখনো প্রেমিকমন। এই সবকিছুরই দেখি কবি সাঈদুলের ‘আদিম আলো’ কাব্যগ্রন্থে। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ এই বইটির সৌন্দর্য কবিতার মতই দৃষ্টিনন্দন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট