চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

শুঁটকি শুকানোয় মৌসুমী ব্যস্ততা

মরিয়ম জাহান মুন্নী

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ১:০৮ অপরাহ্ণ

কড়া রোদে দাঁড়িয়ে বড় আকারের রুপচাঁদা মাছকে বাঁশের মাচায় শুকাতে দিচ্ছেন আয়েশা বেগম। বয়স আনুমানিক ৪০ থেকে ৪৫ বছর। রোদে পুড়ে কালচে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে তাঁর গায়ের রং। শুধু তিনিই নন, রোদে শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত খাদিজা, মরিয়ম, রাশেদ ও তাদের পরিবারের ছোট-বড় অন্যান্য সদস্যরাও। সবাই মাছকে শুঁটকিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত।
এসময় চট্টগ্রামের শুঁটকি পল্লিগুলোতে দিনভর চলে শুঁটকি শুকানো কাজ। এরমধ্যে নগরীর কর্ণফুলী নদীর উত্তর-দক্ষিণ তীরঘেঁষা বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর, কর্ণফুলী ঘাট, ফিসারি ঘাট, চাক্তাই ও রাজাখাল তীরগুলোতে পুরোদমে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রতিদিন সূর্যের তাপে এসব এলাকার শতাধিক স্পটে ছোট-বড় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ শুকানো হচ্ছে। পুরুষ, নারী-শিশুসহ প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন এ শুঁটকি উৎপাদন কাজে। প্রতি বছর কার্তিক থেকে মাঘ এ চার মাস মাছ ধরে শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত থাকে এ শ্রমিকরা। চট্টগ্রামের শুঁটকির সুখ্যাতি রয়েছে দেশ-বিদেশজুড়ে। অতিথি আপ্যায়নেও এর জুড়ি মেলা ভার।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, দূর থেকে মাইলের পর মাইল মাচায় নানা রকমের শুঁটকি চেয়ে আছে চারদিক। আঁধা কিলোমিটার দূর থেকেই শুঁটকির গন্ধ ভেসে আসে। যতদূর চোখ যায় বাঁশের মাচায় শুঁটকি আর শুঁটকি। ধবধবে সাদা শুঁটকির মাঝে বাদামি আর লালছে রঙ্গের শুঁটকির মাচাও দেখা যায়। কোনো মাচায় সমুদ্র থেকে মাত্র মাছ এনে বিছিয়ে দিচ্ছে শ্রমিকরা। কোনো মাচায় অর্ধ শুকনো শুঁটকি একটা একটা করে উল্টে দিচ্ছে বিপরীত পিঠে রোদ লাগার জন্য। আবার কোনো মাচায় প্রায় শুকনো শুঁটকি এখনো রোদে রাখা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে বাকলিয়া ক্ষেতচর বস্তিতে এভাবেই শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করছে শ্রমিকরা। এখান থেকে শুঁটকিগুলো নগরীর আছাদগঞ্জ আড়তে যাচ্ছে। প্রতি মৌসুমে কোটি টাকার শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করা হয় এখান থেকে। বর্তমানে সারাদেশের শুঁটকি চাহিদা প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ মেট্রিক টন।
চট্টগ্রামবাসীর খাদ্য তালিকায় শুঁটকি অন্যতম। প্রতিদিনের খাবারে তরকারির সাথে চাই যেকোন শুঁটকি। শুঁটকি ভর্তা, ডাল দিয়ে শুঁটকির কারি ও শুঁটকি মরিচসহ বাহারি শুঁটকির খাবার তৈরিতে প্রসিদ্ধ চট্টগ্রাম। স্বাদের দিক থেকে অতুলনীয় চট্টগ্রামের শুঁটকি শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও পছন্দের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে। তবে এরমধ্যে কিছু শুঁটকি বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এসব শুঁটকির মধ্যে ছুরি, লইট্ট্যা, পোয়া, ল্যইক্কা, ফাইস্যা মাছের শুঁটকি অন্যতম। যেগুলো বর্তমানে অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে। একটু অল্প দামের মধ্যে আছে চিংড়ি ও মিশালি মাছের শুঁটকি। কিন্তু কালের বিবর্তনে চট্টগ্রাম সেই নিজস্বতা হারাতে বসেছে। শুঁটকির ঐতিহ্য অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ফরমালিন ও আমদানি করা শুঁটকিতে প্রকৃত স্বাদ-সুঘ্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকেও আমদানি করতে হচ্ছে শুঁটকি।
চাক্তাইয়ের শুঁটকির ব্যবসায়ী মনতাজ মিয়া বলেন, সাগর থেকে বড় ট্রলারে মাছ ধরার কারণে সাগরে মাছের সংখ্যা কমে আসছে। এ ট্রলারগুলোয় জাটকা মাছ ধরা হয়। তাই দেখা যায় এসব মাছের সাথে বিভিন্ন প্রজাতির মাছও মরে যায়। এতে সাগরে মাছে কমে আসছে। তবে শীতের সময় সাগর শীতল থাকে। জেলেরাও মাছ ধরতে পারেন। আর গরমকালে সাগর উত্তাল থাকে, জেলেরা ভয়ে সাগরে যেতে পারে না। শীতকালীন শুঁটকির মজাই আলাদা। শীতকালে রৌদ্রে শুকানোর ব্যবস্থা থাকলেও বর্ষাকালে সেই অবস্থা নেই। বর্ষকালে ফরমালিন দিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। প্রতি বছরই শুঁটকি তৈরি করা হয়। কিন্তু প্রকৃত স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যায় না। শুঁটকির নানা জাতের মধ্যে লাক্ষ্যা, কোরাল, রূপচাঁদা, ছুরি, ফাঁইস্যা, লইট্টা, পোয়া অন্যতম। তবে রূপচাঁদা ও ছুরি শুঁটকি বাজার থেকে কমে যাচ্ছে। একসময়ে এ পাইকারি বাজারের শুঁটকি থেকে দেশের ৮০ শতাংশ শুঁটকির চাহিদা মেটানো হত। এখন সেই অবস্থা আর নেই। শুঁটকির জোগান এখন অর্ধেকে নেমেছে। অবশিষ্ট শুঁটকি ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করে মেটানো হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশর কক্সবাজার, টেকনাফ, সুন্দরবন, সুন্দরবন সংলগ্ন দুবলার চর, কুয়াকাটা, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, হাতিয়া, সোনাদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায়ও শুঁটকি তৈরি হয়ে। কিন্তু চট্টগ্রাম, সোনাদিয়া, রাঙাবালি ও দুবলার চর এলাকার শুঁটকির স্বাদ পৃথিবীর আর কোথায় আছে কিনা সন্দেহ। প্রকৃতি যেন অকৃপণভাবে সেই স্বাদ দান করেছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট