চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

বিশ^ময় শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হোক নতুন বছরে

মাহমুদ আহমেদ

২ জানুয়ারি, ২০২০ | ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় আমরা নতুন বছরে প্রবেশ করছি। আল্লাহপাক কোরআন করিমে ইরশাদ করেন: ‘নিশ্চয়ই আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারোটি’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)। আল্লাহতায়ালা আরো ঘোষণা করেন: ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এ সমস্ত নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৫)।

যাহোক, বছর আসে আবার বারো মাস অতিবাহিত হওয়ার পর তা শেষ হয়ে নতুন বছর শুরু হয়। সাধারণত দেখা যায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে লোকেরা হৈ-হুল্লোড় ও ক্রীড়া-কৌতুক আর জাগতিক আনন্দ-উল্লাসের মাঝে সারা রাত কাটিয়ে দেয় আর এতে এমন কোন অপকর্ম নেই যা পাশ্চাত্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে না করা হয়। আমাদের নিজেদের কর্ম নিয়ে একটু তো চিন্তা করা উচিত যে, আমরা কি করছি? যেভাবে ইসলামী জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) একবার মিম্বরে দাঁড়িয়ে তার খুতবায় এক ঐতিহাসিক উক্তি উপস্থাপন করেছিলেন, যা ইমাম তিরমিজি (রহ.) স্বীয় গ্রন্থ তিরমিজি শরিফ এবং ইমাম ইবনে আবি শায়বা (রহ.) স্বীয় গ্রন্থ মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বায় উল্লেখ করেন। হজরত ওমর (রা.) বলেছিলেন, ‘হিসাব চাওয়ার আগে নিজের হিসাব করে নাও, তোমার কাজ পরিমাপ করার আগে নিজেই নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও’ (জামে তিরমিজি)।

অথচ আমরা এটি ভেবে দেখি না যে, জীবন থেকে একটি বছরের সমাপ্তি ঘটছে আর প্রবেশ করছি নতুন বছরে, যেখানে আমার করণীয় হল সৃষ্টিকর্তার দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, নিজের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, নতুন বছর যেন সর্বদিক থেকে মঙ্গলময় হয় সেই দোয়া করা। অথচ তা না করে আমরা সব ধরনের বৃথা কার্যকলাপ এবং অপকর্ম করে নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছি। নববর্ষের মতো সময়ের একটি এহেন গুরুত্বপূর্ণ পর্বে এমন কোনো কাজ করা সমীচীন হবে না, যা আমাদের আমলনামা বা জীবনপঞ্জিকে কলঙ্কিত করবে। হজরত আলী (রা.) বলেন: তুমি রাতের আঁধারে এমন কোনো কাজ কোরো না, যার কারণে তোমাকে দিনের আলোয় মুখ লুকাতে হবে।
আসলে আজ পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই তাদের দৃষ্টি সেখানে পৌঁছা সম্ভব নয় যেখানে একজন মুমিনের দৃষ্টি পৌঁছে। একজন মুমিনের মহিমা হল এই সমস্ত বৃথা কার্যকলাপ এড়িয়ে চলা, বরং আত্মজিজ্ঞাসা করা যে, আমাদের জীবনে একটি বছর এসেছে এবং চলে গেছে, এই বছরটি আমাদের কী দিয়ে গেল বা কি নিয়ে গেল আর আমরা কি পেলাম আর কি হারালাম?
একজন মুমিন এটাই দেখবে যে, জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ বছর সে কী হারিয়েছে আর কি পেয়েছে? তার জাগতিক অবস্থা বা বৈষয়িক অবস্থায় কি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। সে বিগত বছরে কি কি পুণ্যকর্ম করেছে আর এবছর যেন আরো বেশি পুণ্যকর্ম করতে পারে সেই চেষ্টায় সে নতুন বছরকে বরণ করবে তাহাজ্জুদ নামাজ এবং বিশেষ ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে।
আমাদের দুর্বলতার জন্য মহান আল্লাহপাকের দরবারে এই দোয়া করতে হবে, হে আল্লাহ! আমাদের আগত বছর যেন বিগত বছরের ন্যায়

আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে দুর্বল না হয় বরং আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ ও পদচারণা যেন তোমার সন্তুষ্টির লক্ষে হয়। আমাদের প্রতিটি দিন যেন বিশ^নবী ও শ্রেষ্ঠনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শে অতিবাহিত হয়। আমরা যেন পবিত্র কোরআন এবং প্রকৃত ইসলামের শিক্ষানুসারে জীবন পরিচালনা করতে পারি। এই দোয়া যদি আমাদের হয় আর আমরা যদি নববর্ষের সূচনায় আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মবিশ্লেষণ করি তাহলে আমাদের পরিণতি অবশ্যই শুভ হবে।
হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর দাদা তার পিতাকে পারস্যের নওরোজের দিন অর্থাৎ নববর্ষের দিন হজরত আলী (রা.)-এর নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছু হাদিয়া পেশ করেছিলেন। তখন হজরত আলী (রা.) বললেন, ‘নওরোজুনা কুল্লা ইয়াওম’ মুমিনের প্রতিটি দিনই তো নববর্ষ। অর্থাৎ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব নিকাশ করবে এবং নবউদ্যমে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে। আমাদের বছর যদি শুরু হয় উত্তম কাজ দ্বারা আর আল্লাহপাকের কাছে কামনাও থাকে যে, সারা বছরই যেন আমাকে ভাল কাজের তৌফিক দান করেন তাহলে অবশ্যই আমার জীবন হবে শান্তি ও কল্যাণময়।

মূলত আমরা যে উত্তম ও পূণ্যময় কাজ করি তা আসলে আমাদের নিজেদের জন্যই কল্যাণকর হয়ে থাকে। যেভাবে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন করিমে ইরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি আমলে সালেহ করে তা তার নিজের জন্যই’ (সুরা জাসিয়া, আয়াত: ১৫)। এই আমলে সালেহ বা উত্তম কাজ বলতে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমষ্টিগত জীবনে সর্বস্তরের ছোট-বড় সকল প্রকাল কল্যাণকর কাজকেই বুঝানো হয়েছে। এখানে সমাজকল্যাণমূলক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক ইত্যাদি সব রকমের কাজই যদি ইসলামের অনুশাসন অনুযায়ী হয় তবেই না তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে উত্তম কাজ হিসেবে পরিগণিত হবে। আর এসব কাজের মাধ্যমেই প্রকৃত ঈমানের পরিচয় ও প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই আমরা যদি বছরের শুরুতেই এই অঙ্গীকার করি যে, নতুন বছরে আমি কোন মন্দ কাজ করব না আর এ বছর সকল পূণ্যকর্মগুলোকে নিজেদের জীবনের সঙ্গী বানিয়ে নিব তাহলে আমাদের জীবন হবে শান্তিময় এবং আল্লাহপাকও আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন।
আল্লাহরপাক এটাই চান যে, তার বান্দারা যেন সব সময় সৎ কাজ করে, তারা যেন অন্যায় কোন কাজে অংশ না নেয়। সামান্য পূণ্যকর্মকেও তিনি বৃথা যেতে দেন না। তিনি তার বান্দাকে ক্ষমা ও রহমতের চাদরে আবৃত করতেই বেশি পছন্দ করেন।

যেমন হাদিসে উল্লেখ আছে, হজরত আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত নবী করিম (স.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি একটি সৎ কাজ করবে, সে এর দশ গুণ অথবা অধিক সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি একটি অন্যায় করবে, সে তেমনি একটি অন্যায়ের শাস্তি পাবে অথবা আমি মাফ করে দিব। যে ব্যক্তি আমার এক বিঘত নিকটবর্তী হবে, আমি তার এক হাত নিকটবর্তী হবো, যে ব্যক্তি আমার এক হাত নিকটবর্তী হবে, আমি তার দুই হাত নিকটবর্তী হবো। যে ব্যক্তি হেঁটে হেঁটে আমার কাছে আসবে আমি দৌঁড়ে তার কাছে যাবো। যে ব্যক্তি পৃথিবী সমান গুনাহ নিয়ে আমার সাথে সাক্ষাত করবে, অথচ সে আমার সাথে কোন কিছু শরীক করেনি, আমি তার সাথে অনুরূপ পৃথিবীভর্তি ক্ষমা নিয়ে সাক্ষাত করবো (মুসলিম)।

তাই আমাদেরকে জাগতিকতার আনন্দ-উল্লাসে ডুবে না গিয়ে মহান আল্লাহর স্মরণে বছরের সূচনা করতে হবে এবং সারা বছরই যেন আমার দ্বারা কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত না হয় তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আর তবেই না আল্লাহপাক আমাদের ছোট-খাট ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহতায়ালা নতুন বছর দেশ, জাতি এবং গোটা বিশ্বের সবার জন্য অফুরন্ত কল্যাণ বয়ে আনুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

মাহমুদ আহমেদ গবেষক, কলাম লেখক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট