চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যঝুঁকি

এ বি জিয়াউদ্দিন হোসেন

২ জানুয়ারি, ২০২০ | ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

নিয়ম বহির্ভূত ও অযাচিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ঔষধ ব্যবহারের কারণে মানুষের শরীরের পাশাপাশি পরিবেশেরও মারাতœক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ইদানীং অনেক ডাক্তার সামান্য রোগের কারণে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করছেন। বিশেষ করে ফার্মেসিগুলোর মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ঔষধের অবাধ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার চলছে। বহু লোক ঔষধের জন্য সরাসরি এসব ফার্মেসির দ্বারস্থ হয়ে থাকে। ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ। মানুষসহ গবাদিপশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক (বিশেষ করে পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন গ্রুপ) প্রবেশ করার পর এর কার্যকারিতা শুরু হয় এবং মলমূত্রের মাধ্যমে নির্গত হয়েও তা সক্রিয় থাকে। নির্গত হবার পর তা পানি এবং মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। পানিবাহিত হয়ে তা নদী ও শেষে সমুদ্র পর্যন্ত গড়ায়। অ্যান্টিবায়োটিক যেখানেই অবস্থান করে সেখানেই ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে থাকে। কিন্তু পানি ও মাটিতে বহু ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব রয়েছে, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু নিয়ম বহির্ভূত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ রক্ষাকারী এসব অণুজীবের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে।

বিদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন থাকলেও আমাদের দেশে তা না থাকায় বৈধ-অবৈধভাবে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠা ফার্মেসিসমূহ সামান্য জ্বরেও সাধারণ রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকে। এছাড়া ঔষুধ কোম্পানীসমূহের অযাচিত চাপ, যেমন- লোভনীয় মূল্য হ্রাস, উপহার প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ঔষধ প্রেস্ক্রাইব ও বিক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক তার নিজস্ব ধর্মানুযায়ী অপরিবর্তিত অবস্থায় ব্যাকটেরিয়াবিরোধী কার্যক্ষমতা অক্ষুন্ন রেখেই মানুষের মলমূত্র দিয়ে নির্গত হয় এবং তা নর্দমা, নদী, মাটিতে মিশে গিয়ে পরিবেশের সহায়ক নাইট্রোজেন, কার্বন, অক্সিজেনচক্র রক্ষাকারী অণুজীবসমূহের বাসস্থান ধ্বংস করে দিচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ২২ হাজার কোটি টাকার অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টি ব্যাকটোরিয়াল এজেন্টসহ অন্যান্য ঔষধ বিপুল পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে, যার পরিমাণ কয়েক হাজার টন ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা মলমূত্র দিয়ে এদেশের নদী মাটিতে স্তূপ হচ্ছে।

অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত ছত্রাক নামক অণুজীব হতে প্রস্তুত করা হয় এবং শরীর বৃত্তীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করার দরুণ এসব অ্যান্টিবায়োটিক অপরিবর্তিত অবস্থায় নিজ কার্যক্ষমতা অক্ষুন্ন রেখেই মল-মূত্র দিয়ে নির্গত হয়। ফলে মাটি-পানিতে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া এদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে এবং পরিবেশের জন্য যত সংখ্যক ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজন তার সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে। ফলে পরিবেশের অস্তিত্ব রক্ষাকারী প্রধান চক্রসমূহ, যেমন- অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদি চক্রের গতি ও হার কমে গিয়ে ধীর বিষক্রিয়ার মত পরিবেশের ক্ষতি করে, যা মানবকুলকে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে। অন্যদিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্টসহ অন্যান্য ঔষধসমূহ শরীরবৃত্তীয় বিপাকক্রিয়ায় অংশগ্রহণকরতঃ বিপাকজাত পদার্থ রূপে মাটিতে ও পানিতে জমা হচ্ছে। এদের মধ্যে কোন কোনটি ব্যাকটেরিয়াবিরোধী ভূমিকা পালন করতে পারে, পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ রূপে বিপাকীয় পদার্থসমূহ (মেটাবোলাইটস) জমা হয়ে মাটি ও পানির ভৌত গঠনের পরিবর্তন ঘটিয়ে পরিবেশের প্রধান উপাদানসমূহের স্বাভাবিক কার্যক্রমের বিঘœ সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত পরিবেশে প্রধান পাঁচটি অণুজীব যেমন ব্যাকটেরিয়া, একটিনো মাইসেটিস ছত্রাক, শৈবাল ও প্রোটোজয়া রয়েছে, যাদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ব্যাপক। মাটি ও পানিতে বিদ্যমান এসব অণুুজীব ও জৈব-অজৈব পদার্থের পারস্পরিক ক্রিয়া ও সম্পর্ক নিয়ে পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র (ঊপড় ঝুংঃবস) গঠিত। আণুবীক্ষণিক পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি গ্রাম শুষ্ক মাটিতে প্রায় ১০০-১০০০ কোটি ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। সে হিসেবে দেখা যায়, প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১০০-৪০০০ কেজি জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া আছে। এদের মধ্যে ব্যাসিলাস, ক্লসট্রিডিয়াম, করিনি ব্যাক্টেরিয়াম, সিউডোমোনাস, স্ট্যাপাইলোকক্কাস, স্ট্রেপটোকক্কাস এবং জ্যানথোমোনাস উল্লেখযোগ্য। বাস্তুতন্ত্রে এসব ব্যাকটেরিয়া বিয়োজক হিসেবে কাজ করে। এদের দেহ হতে ক্ষয়িত পদার্থ দিয়ে মৃত প্রাণী ও উদ্ভিদকে পচনে সাহায্য করার মাধ্যমে জীবের জটিল যৌগসমূহকে সরল বস্তুতে রূপান্তর করতঃ সবুজ উদ্ভিদ, শৈবালসহ শক্তি উৎপাদন জীবসমূহের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে। আর এদেরকে ভক্ষণের মাধ্যমে মানুষসহ জগতের সকল প্রাণীকুল সূর্য হতে সঞ্চিত শক্তি প্রাপ্ত হয়। পাশাপাশি পচনশীল জীব হতে গ্যাসীয় উপাদান যেমন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদি অবমুক্ত করত পরিবেশে এদের ভারসাম্য রক্ষা করে। অতএব, এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, পরিবেশ রক্ষাতে ব্যাকটেরিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। অতএব, ব্যাকটেরিয়াসহ পরিবেশের অন্যান্য উপাদানসমূহ (যেমন- পানি, মাটি ও বায়ু) যদি অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ঔষধ দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে ক্রমান্বয়ে পরিবেশের স্বাভাবিক গতি নষ্ট হতে বাধ্য। তাই সময়ের দাবি হচ্ছে এই মুহূর্ত হতেই এ নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণা চালানো জরুরি।

অনেক সময় বাইরের কোনো দেশে নতুন ঔষধ আবিষ্কার হলেই আমাদের দেশে তা বিভিন্ন আমদানীকারক ঔষধ কোম্পানি ‘ঋরৎংঃ ঃরসব রহ ইধহমষধফবংয’ শ্লোগানে ডাক্তারদেরকে প্রেসক্রাইব করতে প্ররোচিত করে থাকে। অথচ আমাদের দেশে বিদ্যমান ঔষধগুলোর কার্যকারিতা সংশ্লিষ্ট রোগের ক্ষেত্রে হ্রাস পাই নি। দেশে বিদ্যমান ঔষধগুলোর কার্যকারিতা সংশ্লিষ্ট রোগের ক্ষেত্রে হ্রাস পেলেই কেবল নতুন ঔষধ আমদানি করা যেতে পারে। এ জন্য বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে “চিকিৎসা প্রোটোকল” নির্ধারণ করতঃ প্রোটোকলে উল্লেখিত ঔষধগুলোই কেবল বাজারজাত করা যাবে- এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা উচিত। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ঔষধের অপব্যবহার বন্ধে জোরালো জনসচেতনতা কর্মসূচিও থাকতে হবে।

এ বি জিয়াউদ্দিন হোসেন গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট