চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

নতুন বছরে স্বপ্নময় প্রত্যাশা

রেজা মুজাম্মেল

১ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

নতুন বছর। নতুন দিন। নতুন স্বপ্ন নিয়ে পুর্বাকাশে নতুন সূর্য উদিত হয়েছে। ফলে নতুন প্রত্যাশা থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। স্বাভাবিক এ প্রত্যাশা নিয়ে চলছে সময়-ক্ষণ। বিদায়ী বছরকে সামনে রেখে নতুন বছরের স্বপ্ন দেখা, নতুন করে বাঁচার প্রত্যয়, নতুন আঙ্গিকে দিনাতিপাত করার ব্রত- এতসব আশা জাগানিয়ায় স্বপ্ন থাকে দিনবদলের। আগামী দিনের পরিবর্তনের। সত্য, সুন্দর ও প্রত্যয়ের। পুরাতন বছরের গ্লানি, হতাশা, দুঃখ-বেদনা ছাপিয়ে নতুনত্বকে বরণ করাই স্বপ্ন সকলের। থাকে অবারিত স্বপ্নকে আলিঙ্গন করার প্রত্যয়। নববর্ষের নবচেতনা, নব উদ্দীপনায় ভরে তোলার বাসনা থাকে সাকলের। থাকে আনন্দ, উচ্ছ্বাস। পুরোনো বছর হোক নতুন বছরের পথচলার পাথেয়। বিদায়ী বছরের ভুলকে শুধরিয়ে স্বপ্নময় আগামী দিনের প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

কিন্তু আসলে কি সত্য, সুন্দর ও প্রত্যয়কে আলিঙ্গন করার সুযোগ আছে? বিদায়ী বছরের দুঃখগুলো কি মুছবে? বিগত দিনের গ্লানি কি পিছন পিছন তাড়া করবে? কঠিন সত্যকে কি সামনে আনা যাবে? অন্যায় ও অসত্যের ডামাডোল কি অবদমিত হবে। মিথ্যার বিরুদ্ধে কি কণ্ঠ উচ্চকিত করার, হওয়ার সুযোগ আসবে। বিচ্ছুরিত আলো কি ছড়াবে? সময়, সমকালীন বাস্তবতা কী বলে? নাকি অতীতের গ্লানি, দুঃখ-বেদনা ভর করবে নতুন বছরেও। তবে আশা-নিরাশার সমীকরণ কী হয় কিংবা হবে তা নিয়ে ইতিবাচক প্রত্যাশা রাখা যায়, রাখতে হবে। বেঁেচ থাকার তাগিদে আশা জাগানিয়া স্বপ্ন দেখতে হয়। তবুও অক্টোপাশের মত মানুষের নানা সমস্যা-সংকট মানুষকে জেঁকে বসে আছে। এসব সমস্যা উত্তরণ অনেকের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ফলে সমস্যা-সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খায় অনেকের জীবন।
নতুন বছরের সূচনালগ্নে স্বপ্ন দেখার নানা অনুষঙ্গ আছে আমাদের সামনে। এ অনুষঙ্গ হলো উন্নয়নযজ্ঞের। সন্দেহ নেই, দেশে এখন নানাক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বাদ যাচ্ছে না চট্টগ্রামও। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ হচ্ছে দেশের প্রথম এবং দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধু টানেল। এটির মোট দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪০০ মিটার বা ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। নদীর তলদেশে ৯৪ মিটার দীর্ঘ ও ২২ হাজার টন ওজনের টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে চলছে খননের মূল কাজ। প্রতি আটটি সেগমেন্টে তৈরি হচ্ছে দুই মিটারের একটি রিং। বর্তমানে প্রকল্পের ৫৫ শতাংশ। ‘ডুয়েল টু লেন’ টাইপের ‘শিল্ড ড্রাইভেন মেথড’ পদ্ধতিতে নির্মিণাধীন টানেলটির কাজ নির্ধারিত মেয়াদকাল ২০২২ সালেই হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন অর্থায়ন করছে প্রায় চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

তাছাড়া, মীরসরাই নির্মাণ হচ্ছে দেশের বৃহত্তম ইকনোমিক জোন। মিরসরাইয়ে ২৭ হাজার একর জমির ওপর নির্মিত দেশের প্রথম পরিকল্পিত শিল্পশহরে এক লাখের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে। মিরসরাইয়ে ৩০ থেকে ৫০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। আনোয়ারায় হচ্ছে পৃথক আরো দুটি চায়না ইকনোমিক জোন। একইভাবে সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে চলছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজও। বর্তমানে চট্টগ্রামেও চলছে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নানা প্রকল্প। এর মধ্যে আছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেটে নির্মাণাধীন ‘সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর স্থাপন’, চুয়েটে ‘রোবোটিকস্ ল্যাব’, ‘মোবাইল গেইম এন্ড এ্যাপস ডেভলপমেন্ট সেন্টার’, জেলা প্রশাসনের আইসিটি বিভাগের আইডিয়া প্রকল্প, ‘সোস্যাল মিডিয়া প্যারেড’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রস্তাবিত ‘হাইটেক পার্ক’, চবি’র ‘মোবাইল গেইম এন্ড এ্যাপস ডেভলপমেন্ট টেস্টিং ল্যাব’, চট্টগ্রাম জেলার ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও ‘ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাবের মনিটরিং শীর্ষক প্রকল্প। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার স্বপ্ন দেখছে দেশ। বিকাশমান প্রযুক্তির এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে এটিই সবার কামনা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নতুন রূপ পাবে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। অন্যদিকে, উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী নিয়ে আশার আলো দেখা দিয়েছে। হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে চলছে নিয়মিত অভিযান, প্রথমবারের মত হালদার পোনা ফেলা হয়েছে হালদায়, সরকারি উদ্যোগে হ্যাচারি সংস্কার করে রেণু থেকে পোনা ফোটানোর ব্যবস্থা, বন্ধ করা হয়েছে ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন, জব্দ করা হয়েছে ইঞ্জিনচালিত বোট, দিন-রাত নদী পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা, কাঠের বোট ও কারেন্ট জাল, আদায় করা হয়েছে জরিমানা। সন্দেহ নেই, এসব উদ্যোগ হালদা নদীকে সুরক্ষা দেবে। কারণ এটি দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ।

কিন্তু এতসব আশার আলোর মধ্যে হতাশার আধারও উঁিক দেয়। প্রথমেই বলা যায়, কর্ণফুলী নদীর কথা। আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী নদীর তীরে দুই হাজার ২৮৯টি অবৈধ স্থাপনার একটি তালিকা প্রকাশ করে। গত ২০১৯ সালের ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসন টানা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ, আলোর মুখ দেখে পাঁচটি খালের মুখ এবং উদ্ধার করা হয় থাকা প্রায় ১০ একর ভূমি। কিন্তু এরপর থেকে উচ্ছেদ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় আট মাস ধরে বন্ধ উচ্ছেদ অভিযান। বর্তমানে দুই হাজার ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এ নিয়ে প্রশাসন এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়, তৈরি হয় নানা অভিযোগ। শঙ্কা আছে উচ্ছেদকৃত স্থান ফের বেদখল হয়ে যাওয়ার। কারণ কর্ণফুলী কেবল একটি নদী নয়, এটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপি- চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ। দেশের প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক ঐতিহ্য। অথচ এটিই আজ চরম অবহেলার শিকার। অন্যদিকে আরেক হতাশার চিত্র প্রতিদিনই এঁেক দিচ্ছে নগর উন্নয়নের প্রধান সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে নগরের মোড়, ফুটপাতগুলো এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে। নগরবাসী সৌন্দর্যবর্ধন চাই, কিন্তু ফুটপাত ও সড়কের গলা টিপে নয়। বর্তমানে নগরের অন্তত ৩৩টি মোড়-ফুটপাতে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বেদখল হয়ে গেছে। এসব ফুটপাতে যাত্রীর স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তির স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী নগরবাসীর। ফলে সংকুচিত হয়ে এসেছে পথচারি-যাত্রীদের চলার পথ। উন্নয়নে আলোর রেখা বিচ্ছুরিত হলেও কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, বাণিজ্যিক মনোভাব এবং আন্তরিকতার অভাবে দুঃখ-হতাশা লেগেই থাকে। আশা আছে, কিন্তু নিরাশাও পিছু ছাড়ছে না।

আজ ২০২০ সালের প্রথম সকাল। ভোরে সূর্য মামা রক্তিম আভা নিয়ে উঁকি দিচ্ছে। নতুন আলো দিচ্ছে পৃথিবীবাসীকে। ভোরের সতেজ এ আলো সকলকেই বিচ্ছুরিত করুক। এ আলোর ঝলকানিতে পুরোনো দুঃখ, বেদনা, হতাশা, যাতনা সবগুলোই মিশে যাক ধুলোয়। শুরু হোক নব সৃষ্টিশীলতার চেতনা। সৎ, সত্য ও সুন্দরের আলোয় আলোকিত হোক প্রতিটি সময়, ক্ষণ। বিদূরিত হোক সকল বাধা-বিপত্তি। মানসিকতা তৈরি হোক নবউদ্যম আর কর্মচাঞ্চল্যের। স্বপ্ন দেখা আর বাস্তবায়নের সমীকরণ যেন হাতের মুঠোয় থাকে। দিন বদলের প্রত্যয় যেন সোনার হরিণ না হয়। সত্য, সুন্দর, ন্যায় দিয়ে মসৃণ হোক আগামীর পৃথিবী।

রেজা মুজাম্মেল গণমাধ্যমকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট