চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হান্নান-জিয়ার উপস্থিতি ও স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পটভূমি

পূর্ব প্রকাশিতের পর

৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:০২ পূর্বাহ্ণ

২৬ মার্চ সকাল থেকে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা খুঁজতে থাকেন জিয়াউর রহমানকে। কিন্তু খবর পাওয়া যায় ২৬ মার্চ ভোররাতে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে জিয়াউর রহমান তাঁর দলবল নিয়ে বোয়ালখালী থানার করলডাঙ্গা পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নিয়েছেন।

শহরে সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্রে জিয়ার অবস্থানের কথা জানতে পেরে ২৬ মার্চ এম এ মান্নান, এম এ হান্নান, ডা. এম এ মান্নান এমপি, আতাউর রহমান খান কায়সারসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বেলা ১১টা থেকে ১টার মধ্যে করলডাঙ্গা এলাকায় গিয়ে জিয়াউর রহমানকে অনুরোধ করেন বেতার কেন্দ্রে এসে কিছু বলার জন্য। জিয়া তাঁদের জানান, সবাই পরিশ্রান্ত, রণকৌশল ঠিক করে তিনি পর দিন (২৭ মার্চ) বেতার কেন্দ্রে আসবেন।

বোয়ালখালী ও পটিয়ার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী যাঁরা ওই এলাকায় বাঙালি সৈন্যরা যাওয়ার পর তাদের আশ্রয়, খাবার ও পোশাক জোগাড় করাসহ নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন, তাদের কাছ থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমান ও তাঁর সঙ্গী কয়েকজন কর্মকর্তা ২৬ ও ২৭ মার্চ একাধিকবার পটিয়া ও বোয়ালখালীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং রণকৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত থাকেন। ২৬ মার্চ সকালে পটিয়া থানায় এসে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এক পর্যায়ে আবার চলে যান বোয়ালখালী। সম্ভবত ওই সময়টাতে বোয়ালখালীতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, তাঁকে খুঁজতে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের
এদিকে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি এসে পৌঁছে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ অবস্থায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলেন কেউ কেউ। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ। জিয়াউর রহমানের পটিয়ায় অবস্থানের কথা জানতে পেরে ২৭ মার্চ সকাল প্রায় ১১টার পর পটিয়া থানায় যান আরও পাঁচ সঙ্গীÑমাহমুদ হোসেন, ফারুক চৌধুরী, ওসমান গণি, কাজী হাবিব উদ্দিন ও এয়ার মোহাম্মদসহ। বেলাল মোহাম্মদ জিয়াউর রহমানের কাছে বেতারের প্রচার ভবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন। ইতিপূর্বে এম এ মান্নান, এম এ. হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার এবং সবশেষে বেলাল মোহাম্মদের আহ্বান বিবেচনায় আনেন মেজর জিয়া। তিনি সম্মতি দেন এবং অল্প কিছু দূরত্ব বজায় রেখে তিনটি লরিতে করে একদল সৈন্য কালুরঘাট বেতারের দিকে পাঠিয়ে দেন। পরে কয়েকজন ক্যাপ্টেনসহ একটি জিপে করে যান নিজে। এ বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া তিনবার তিন রকমভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ/প্রচার করেন। এর মধ্যে প্রথমবার বঙ্গবন্ধুর নামে সংক্ষিপ্তাকারে, দ্বিতীয়বার নিজের নামে, তা-ও সংক্ষিপ্তাকারে এবং তৃতীয়বার বড় কলেবরে বঙ্গবন্ধুর নামে ঘোষণা পাঠ করেন তিনি। প্রত্যকবার ‘জয় বাংলা’ দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় প্রথমবার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করা ঘোষণাটি ছিল : ‘ঞযরং রং ঝযধফযরহ ইধহমষধ ইধঃধৎ কবহফৎধ. ও, গধমড়ৎ তরধঁৎ জধযসধহ, ধঃ ঃযব ফরৎবপঃরড়হ ড়ভ ইড়হমড়নধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, যবৎব নু ফবপষধৎব ঃযধঃ ঃযব রহফবঢ়বহফবহঃ ঢ়বড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয যধং নববহ বংঃধনষরংযবফ. অঃ যরং ফরৎবপঃরড়হ, ও যধাব ঃধশবহ পড়সসধহফ ধং ঃবসঢ়ড়ৎধৎু যবধফ ড়ভ ঃযব জবঢ়ঁনষরপ. ওহ ঃযব হধসব ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, ও পধষষ ঁঢ়ড়হ ধষষ ইধহমধষরং ঃড় ৎরংব ধমধরহংঃ ঃযব ধঃঃধপশ নু ঃযব ডবংঃ চধশরংঃধহর অৎসু. ডব ংযধষষ ভরমযঃ ঃড় ঃযব ষধংঃ ঃড় ভৎবব ড়ঁৎ গড়ঃযবৎ ষধহফ. ইু ঃযব মৎধপব ড়ভ অষষধয, ারপঃড়ৎু রং ড়ঁৎং. ঔড়ু ইধহমষধ.’

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আমি মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ঘোষণা করছি যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর নির্দেশে আমি এই প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আমি সকল বাঙালিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য আহ্বান করছি। আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে আমরা প্রাণপণ যুদ্ধ করবো। আল্লাহর অনুগ্রহে আমাদের জয় নিশ্চিত। জয় বাংলা।’
তাঁর দ্বিতীয় ঘোষণাটি ছিল এরকম: ‘১ গধলড়ৎ তরধ ফড় যবৎব নু ফবপষধৎব রহফবঢ়বহবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ ড়হ নবযধষভ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ইধহমষধফবংয, ৎবয়ঁবংঃ ধষষ ঃযব ঢ়বধপব ষড়ারহম ঈড়ঁহঃৎরবং ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ, ঃড় মরাব রসসবফরধঃব ৎবপড়মহরঃরড়হ ঃড় ঃযব ঝধিফযরহ ইধহমষধফবংয ধহফ বীঃবহফ ঢ়যুংরপধষ ধংংরংঃধহপব ড়ভ ধষষ ঃুঢ়বং ঃড় ষরনবৎধঃব ঃযব ফবসড়পৎধঃরপ সরহফবফ ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয. টহফবৎ ঃযব পরৎপঁসংঃধহপবং. ও যবৎবনু ফবপষধৎব সুংবষভ ধং ধ ঢ়ৎড়ারংরড়হধষ যবধফ ড়ভ ঝধিফযরহ ইধহমষধ খরনবৎধঃরড়হ এড়াবৎহসবহঃ. ও ঁৎমব ঁঢ়ড়হ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয ঃড় পড়হঃরহঁপব ঃযরং ভৎববফড়স সড়াবসবহঃ রিঃয রহপধৎবধংবফ ারমড়ঁৎ ধহফ রহঃবহংব ংবহপব ড়ভ ফবাড়ঃরড়হ.
ইু ঃযব মৎধপব ড়ভ এড়ফ, ঞযব ারপঃড়ৎু রং ড়ঁৎং, ঔড়ু ইধহমষধ.”

নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে উল্লেখ করে জিয়ার এই ঘোষণাটির কথা অনেকে স্বীকার করলেও এটি প্রচারের সময় নিয়ে পরে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা যায়। ২৬-৩০ মার্চ পর্যন্ত যে সব ঘোষণা পাঠ ও প্রচারিত হয়েছে তার কোনো কোনোটি প্রচার হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু সব লোক, সব নেতা বা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সব ঘোষণা ধারাবাহিকভাবে শুনেছেন এমন নয়। কাজেই কে কোন ঘোষণাটা ঠিক কয়টায় প্রচার বা পাঠ করেছেন তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। ফলে সময়ের ব্যাপার নিয়ে বিভ্রান্তি থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। শব্দ বা ভাষার সঠিক প্রয়োগের কথাও মনে না থাকাও অসম্ভব নয়। কারও কারও মতে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে চলে যাওয়ার পর রাত ১০ টার দিকে জিয়াউর রহমান আবার আসেন বেতারকেন্দ্রে। ওই সময় তিনি নিজের নামে ঘোষণাটি দেন। আবার কারও মতে, দ্বিতীয় ঘোষণাটি তিনি দিয়েছেন ২৮ মার্চ এবং তাঁর প্রথম ঘোষণা পাঠ যাঁরা শোনেননি তাঁরা দ্বিতীয় ঘোষণাটিকেই সম্ভবতঃ প্রথম ঘোষণা বলে মনে করেন। বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বেশিরভাগের বক্তব্য এবং বিদেশি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী জিয়া তাঁর দ্বিতীয় ঘোষণাটি ২৮ মার্চ দিয়েছিলেন। তবে এই ঘোষণাটি মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার পরিপন্থী এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরামর্শে সংশোধিত আকারে তৃতীয় আরেকটি ঘোষণা তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করেন। প্রবীণ নাগরিক ও শিল্পপতি, এ কে খানসহ রাজনৈতিক নেতারা বলেন যে, বিনা পটভূমিতে নিজের নামে এভাবে ঘোষণা দেওয়া ঠিক হয়নি। তাঁর এ ঘোষণা হবে বিচ্ছিন্নতার নামান্তর। বঙ্গবন্ধুর নামে মেজর জিয়ার তৃতীয় ঘোষণাটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় ২৯ মার্চের তিনটি অধিবেশনে। শামসুল হুদা চৌধুরীর ‘মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর’ গ্রন্থে ঘোষণার মূল ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ ছাপা হয়েছে। বাংলায় ঘোষণাটি এরকম:
‘সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার। আমাদের মহান নেতা, বাংলাদেশের একচ্ছত্র নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমরা এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং ঘোষণা করছি যে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই সরকার গঠিত হয়েছে। এতদ্বারা আরও ঘোষণা করা হচ্ছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগণের একমাত্র বৈধ সরকার, যা আইনসম্মত এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে গঠিত হয়েছে এবং যা পৃথিবীর সব সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
কাজেই আমরা আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে বাংলাদেশের বৈধ সরকারকে স্বীকৃত দান এবং পাকিস্তানের দখলদার সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংগঠিত ভয়াবহ গণহত্যাকে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করার উদ্দেশ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।

সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বৈধভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা একটি নির্মম তামাশা এবং সত্যের বরখেলাপ মাত্র, যার দ্বারা কেউই বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়।
নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হবে প্রথমত নিরপেক্ষতা, দ্বিতীয়ত শান্তি এবং তৃতীয়ত সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারও সাথে শত্রুতা নয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। জয় বাংলা।’ (মুক্তিযুদ্ধে মুজবনগর, পৃষ্ঠা-৩৭-৩৮)
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, শামসুল হুদা চৌধুরী জিয়াউর রহমানের আমলে তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আমার অনুবাদ ছিল বঙ্গবন্ধুর নামে : মমতাজ উদ্দিন : ২৭ মার্চের অধিবেশনে সংবাদ বুলেটিন প্রচার করার সময় বেতার সম্প্রচার কেন্দ্রের কার্যালয়ে জিয়ার সঙ্গে ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ। কার্যালয়ের বাইরে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ ও অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। ঘোষণা পাঠ করার আগে ঘোষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা হয় জিয়া, বেলাল মোহাম্মদ ও মমতাজ উদ্দিন আহমদের মধ্যে। ঘোষণার বাংলা অনুবাদে সহায়তা করেন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ (নাট্যকার লেখক)। সম্প্রচার কক্ষে ছিলেন প্রকৌশলী আমিনুর রহমান ও মেকানিক আবদুস শাকুর। পেশাজীবী বেতার সংগঠক হিসেবে বেলাল মোহাম্মদ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত থাকায় ঘোষণা পাঠের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে তাঁর সবচেয়ে ভাল জানার কথা। তিনি লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ঘোষণাটি প্রচারের পরিকল্পনা এবং পা-ুলিপি রচনায় মেজর জিয়া এবং আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। এটি ছিল তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত। ঘোষণার প্রথম বাক্যটি ছিল: ও গধলড়ৎ তরধ, ড়হ নবযধষভ ড়ভ ড়ঁৎ মৎবধঃ হধঃরড়হধষ ষবধফবৎ ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, ফড় যবৎবনু ফবপষধৎব রহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয… Ñ“খোদা হাফেজ” “জয় বাংলা” দিয়ে ঘোষণাটি শেষ হয়।’

২৭ মার্চের ঘোষণা পাঠের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কালুরঘাটে যে রেডিও স্টেশন ছিল, সেটি ছিল ট্রান্সমিটিং স্টেশন। সেখানে ঘটনাক্রমে সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান এসেছিলেন। কোত্থেকে এসেছিলেন, কে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন তা আমি জানতাম না। ২৭ তারিখে আমি সেখানে ছিলাম। আমার ছাত্র আবুল কাসেম সন্দ্বীপ এবং রেডিওর বেলাল মোহাম্মদও ছিলেন। সেখানে একটি ইংরেজি বক্তব্য (ঘোষণা) বাংলা করার প্রয়োজন হয়েছিল। আমি মুখে মুখে অনুবাদ করি, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ সেটি লিখে নেয়। সেটা জিয়াউর রহমান রেডিওতে পাঠ করেছিলেন সেদিন। এটি আমার কাছে আসলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনাই মনে হয় না। কারণ, এরকম লেখা বহুজনে বহুভাবে পাঠ করেছে। আমি ভেবে পাই না সেটি ঘোষণা কেন হবে? এটা তো অপরের জিনিস। অপরজন যা লিখে দিয়েছিল, যে অপরে অনুবাদ করে দিয়েছে সেটা একজন সেনাবাহিনীর লোক পাঠ করেছেন, এটা ঘোষণা কেন হবে? ঘোষণা তো হয়েছে আগেই। আমি এটুকু জানি। আর একটা কথা প্রসঙ্গত বলে রাখি। যে কাগজটা আমি ইংরেজি পেয়েছিলাম, এই কাগজটা কোত্থেকে এসেছিল তাও আমি জানতাম না। সেখানে প্রথম বাক্যটি ছিল ওহ ঃযব হধসব ড়ভ ড়ঁৎ মৎবধঃ ষবধফবৎ ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযধসধহ… আমার এটা বেশ মনে আছে মৎবধঃ ঘধঃরড়হধষ ষবধফবৎ ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযধসধহ, সবটাতো এতদিন পর মনে থাকার কথা নয়। স্মৃতিতে কোথায় চলে গেছে…আমাদের জাতির মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে….এটা আমার মনে আছে। আমি নিশ্চয় অনুবাদে জিয়াউর রহমান বলছি, এ কথা বলিনি। আমার অনুবাদে কোথাও ছিল না।’
ঘোষণাপত্র প্রচার হয়েছিল একাধিক কন্ঠে। ২৭ মার্চের সান্ধ্য অধিবেশনে অনুষ্ঠান ঘোষণার দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল্লাহ আল ফারুক। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। তিনি লিখেছেন, …২৭ মার্চের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কালুরঘাটে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের উপস্থিতি। তাঁকে পটিয়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন বেলাল মোহাম্মদ নিজে। তাঁর কমান্ডে থাকা কিছু সেনাকে ট্রান্সমিটার ভবন সুরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বেলাল ভাইয়ের অনুরোধে স্বাধীনতার পক্ষে বিবৃতি দিতে তিনি রাজি হন। নিজেই ইংরেজিতে লেখেন তাঁর বয়ান। এবং সে বয়ানে ‘অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ কথাটার সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল। এর বাংলা অনুবাদে বেলাল মোহাম্মদকে সাহায্য করেন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। এ ঘোষণার বক্তব্য সংবাদ বুলেটিন হিসেবে প্রচার করেছিলেন আবুল কাসেম সন্দ্বীপ। অনুবাদ প্রথমে পঠিত হয় আমার কন্ঠে। পরে একাধিক কণ্ঠে। ট্রান্সমিশনের দায়িত্বে ছিলেন আমিনুর রহমান ও আবদুস শাকুর। অনুষ্ঠান ঘোষণার দায়িত্বও আমার ওপর বর্তায়।

২৮-২৯ মার্চ থেকে আমরা ট্রান্সমিটার ভবনেই থাকতে শুরু করলাম। খাবার আসত আশপাশের গ্রাম থেকে। স্থানীয় মোহরা গ্রামের দুই ভাই সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী সেকান্দার হায়াত খান ও হারুনর রশিদ খান এই কালুরঘাট প্রচারপর্বে আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তাঁদের কাছে আমাদের অশেষ ঋণ, কখনো শোধবার নয়। ২৮ ও ২৯ মার্চ জিয়াউর রহমান সাহেব ইংরেজিতে আরও দুটি ঘোষণা পাঠ করেন। একটিতে নিজেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রবাসী রাজনৈতিক নেতাদের এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখেছি। পরে অবশ্য তিনি এই দাবির পুনরুল্লেখ করেননি। তাঁর লিখিত ইংরেজি বিবৃতি পাঠ করেন তখনকার তরুণ লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী। ২৬ ও ২৭ মার্চের অধিবেশনেই শুধু বেতারে ‘বিপ্লবী’ নামটি চালু ছিল। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ‘বিপ্লবী’ কথাটা বাদ দেওয়া হয়।

২৮ মার্চ থেকে শুধু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামেই প্রচারকাজ চলেছে একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত।
বেলাল মোহাম্মদ মেজর জিয়ার দ্বিতীয় ঘোষণার কথা উল্লেখ করেন এভাবে ‘আজ (২৮মার্চ) বিকেলে মেজর জিয়াউর রহমান নতুন একটি ঘোষণা লিপি নিয়ে এসেছিলেন। ওতে নিজেকে তিনি চৎড়ারংরড়হধষ ঐবধফ ড়ভ ইধহমষধফবংয এবং বাঙালি সামরিক বাহিনীর প্রধান বলে উল্লেখ করেন। খসড়াটি নিয়ে তাঁর সঙ্গীয় ক্যাপ্টেনদের নিয়ে আলোচনার সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম।

মুহাম্মদ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট