চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

হুমকিতে জনস্বাস্থ্য রোধ করতে হবে অনিরাপদ পানির বাণিজ্য

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

পানির অপর নাম জীবন। সুস্থভাবে বাঁচতে হলে প্রতিদিন পরিমিত বিশুদ্ধ পানি পান করতে হয়। পরিমিত পানি পান না করলে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আবার দূষিত পানি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই সচেতন নাগরিক মাত্রই বিশুদ্ধ পানি পান করতে চান। বিশুদ্ধ পানির জন্যে প্রয়োজনে বাড়তি খরচ করতেও দ্বিধা করেন না তারা। শহরের অনেক মানুষ আজকাল নির্ভর করছেন জার ও বোতলজাত পানির ওপর। কিন্তু বিশুদ্ধ পানির নামে বাজার থেকে কিনে যে পানি পান করা হচ্ছে তা কতটুকু নিরাপদ? বিশুদ্ধ পানির নামে বাজারজাত পানির বেশির ভাগই যে দূষিত এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। দৈনিক পূর্বকোণে গত বুধবার প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন বলছে, বিশুদ্ধ পানির নামে নি¤œমানের ও অস্বাস্থ্যকর পানি বাজারজাত করছে নগরীর ৬৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের নেই বৈধ কোন লাইসেন্স। অনুমোদনহীন এসব কারখানার পানি পানে বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। চিত্রটি খুবই উদ্বেগকর।

বিএসটিআই’র বরাতে প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্য মতে, নগরীতে বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে সর্বমোট ৭৭টি। এরমধ্যে মাত্র ২৫টি প্রতিষ্ঠানের বৈধ অনুমোদন থাকলেও বাকি ৫২টি প্রতিষ্ঠানই অবৈধভাবে পানি উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। অনেকে ছোট ছোট কারখানা তৈরি করে অবৈধভাবে পানি জার ও বোতলজাত করে সরবারাহ করছে। অনেকে ওয়াসার লাইনের পানি বোতলজাত করেও বাজারজাত করছে। বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন ও সরবরাহকারীর লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পানি উৎপাদন করে বোতলজাত করছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে জানিয়েছেন বিএসটিআই’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মোস্তাক আহমেদ। প্রসঙ্গত, অনুমোদন না নিয়ে বা সঠিকভাবে মান নিয়ন্ত্রণ না করে জারের পানি বিক্রি বন্ধে ইতোপূর্বে ঢাকার মতিঝিলে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জারে সরবরাহ করা ৯৭ শতাংশ পানিতে মলের জীবাণু পাওয়া গেছে। এই চিত্র শুধু মতিঝিল এলাকার নয়, সারাদেশেরই চিত্র বলতে হবে। সারাদেশেই এভাবে সংশ্লিষ্ট নজরদারী সংস্থার গোচরে-অগোচরে চলছে দূষিত পানির উৎপাদন ও বিপণন। বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলছে, জীবাণুযুক্ত ও মানহীন জারের পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে দেশের পানির বাজার। খোলা কলের দূষিত পানি ভরে বিক্রি ও বাজারজাত করছে একশ্রেণির অসৎ মানুষ, যা জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। এসব পানি পান করে অনেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মানবদেহে শতকরা ৭৫ ভাগ রোগের কারণ হলো দূষিত পানি। সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, জন্ডিস, আমাশয়, হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস, চর্মরোগ ও মরণব্যাধি ক্যান্সারের মতো বড় রোগ-বালাই বাড়ছে।

প্রশাসনিক শৈথল্যের কারণেই যে দীর্ঘদিন ধরেই দূষিত পানির ব্যবসা চলছে, তা অস্বীকারের সুযোগ নেই। বিভিন্ন সময়ে দূষিত পানির উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে কিছু কিছু পদক্ষেপ দেখা গেলেও দোষীদের শনাক্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় সোপর্দ করার কোনো জনকাঙ্খিত উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে কিছু প্রতারককে আটক করার খবর পত্রপত্রিকায় দেখা গেলেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির খবর দেখা যায়নি। নজরদারী সংস্থাগুলোর নির্লিপ্ততার কারণে এখন শহর থেকে গ্রামাঞ্চলের হাটবাজার পর্যন্ত মিনারেল ওয়াটারের নামে জার ও বোতলজাত দূষিত পানিতে সয়লাব। গ্রামের বাড়ির পাশে ছোট টং দোকানেও মিনারেল ওয়াটারের নামে এই দূষিত পানি দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এসব তথাকথিত ‘মিনারেল ওয়াটার’ পেয়ে লোকজন গভীর নলকূপ কিংবা ফুটানো পানি পান করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত বিশাল জনগোষ্ঠী মিনারেল ওয়াটারের নামে প্রতিদিন কি বিষ পান করছেন সে সম্পর্কে তারা বলতে গেলে একেবারেই অজ্ঞ। এ অবস্থায় একদিকে বিশুদ্ধ পানির নামে স্বাস্থ্যহানিকর পানির ব্যবসা রমরমা রূপ ধারণ করছে, এ অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে অনেকেই ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে সাধারণ মানুষ পড়ছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এমন চিত্র কারো কাম্য হতে পারে না।

অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ায় অতি মুনাফার লোভে নিম্মমানের পানি বাজারজার করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তবে আশার কথা হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে ও তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার উদ্দেশ্যে অভিযানে নেমেছে বিএসটিআই ও দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। গত মঙ্গলবার এমন অবৈধ পানি উৎপাদন ও সরবরাহকারী পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় ও উৎপাদন বন্ধও করেছে সংস্থা দু’টি। ইতোমধ্যে সকল প্রতিষ্ঠানকে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। জানা গেছে, যাদের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন থাকবে না, তাদের সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে। এছাড়া যে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। আমরা মনে করি, জনস্বার্থে এমন অভিযান চলমান থাকুক। যেসব মুনাফালোভী দানব এমন অসৎ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। থাকতে হবে মিনারেল ওয়াটারের নামে বিষপান সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জোরালো কর্মসূচিও।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট