চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হান্নান-জিয়ার উপস্থিতি ও স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পটভূমি

পূর্ব প্রকাশিতের পর

মুহাম্মদ শামসুল হক

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

অনুষ্ঠান ঘোষণার মুহূর্তটির কথা স্মরণ করে রাখাল চন্দ্র বণিক বলেন, ‘বেতারকেন্দ্রে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি কিভাবে প্রচার করা হবে তা আমিসহ এম এ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. এম এ মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী প্রমুখ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হয়।

হান্নান সাহেব ঘোষণার বাংলা অনুবাদ করে আমাকে দেন অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য। বেলা প্রায় দুইটায় মির্জা নাসির ও আবদুস শাকুর ট্রান্সমিটার চালু করেন। আমি ট্রান্সমিটিং রুমে ঢুকেই বললাম, “একটি বিশেষ ঘোষণা, একটি বিশেষ ঘোষণা, আপনারা যাঁরা রেডিও অন করে আছেন তাঁরা রেডিও বন্ধ করবেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক জননেতা এম এ হান্নান।” আমার অনুষ্ঠান ঘোষণা যেহেতু সঙ্গে সঙ্গে প্রচার হয়ে যাচ্ছে তাই এটা অনেকে নাও শুনতে পারেন। তাই একইভাবে ৪-৫ বার বলছিলাম, “বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, আপনারা যাঁরা রেডিও খুলে বসে আছেন তাঁরা রেডিও বন্ধ করবেন না।” একটু পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কথাও উল্লেখ করেছিলাম। বেতার কেন্দ্রের নাম বলেছিলাম ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চট্টগ্রাম’। এরপর হান্নান সাহেব বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণাটি পাঠ করলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান এবং এ ব্যাপারে কিছু নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন।’ রাখালচন্দ্র বণিক বলেন, ‘বেতার কেন্দ্রে গিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা প্রচার করা ছিল একটা সাহসী পদক্ষেপ। কারণ, রাজারবাগ পিলখানায় যে নারকীয় ঘটনা সেদিন ঘটেছিল চট্টগ্রামেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারত। বেলা পৌনে তিনটার দিকে টেলিফোনে আমাদের তাড়াতাড়ি বেতার কেন্দ্র ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে বলা হয়, নিচের দিকে সাঁজোয়া যান এবং ওপর দিক থেকে বিমান হামলা চালানো হবে। কিন্তু আমরা জীবনের পরোয়া করিনি। মোশাররফ সাহেবকে বলেছিলাম, আমরা মরে গেলে অসুবিধা কোথায়।’

২৬ মার্চ ঘোষণা প্রচার শেষে এম এ হান্নান আন্দরকিল্লা চলে আসেন সঙ্গীদের নিয়ে এবং বেতার প্রকৌশলীদের পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেন নিজ নিজ গন্তব্যে। উল্লেখ্য, বেতার অধিবেশন চট্টগ্রাম বেতারের প্রচার ফ্রিকোয়েন্সি-৮৭০ কিলোহার্জ এ প্রচারিত হয়েছিল। সূচনার দিক থেকে এটি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন হলেও অবিন্যস্ত খ-কালীন অধিবেশন হওয়ায় সম্ভবতঃ এটিকে প্রথম অধিবেশন হিসেবে বলতে চাননি বেতারের অন্যতম সংগঠক ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গ্রন্থের লেখক বেলাল মোহাম্মদ। এ সম্পর্কে তাঁর অভিমত হলো: ‘কেন্দ্রের নামকরণই তো হলো সন্ধ্যায় আমার উদ্যোগে। বস্তুত: জনাব হান্নানের মূল্যবান ভাষণটি আমি শুনিনি। কারণ সে সময়ে আমি বেতার কেন্দ্র চালু করার প্রস্তুতি হিসেবে স্টেশন রোডের রেস্ট হাউসে আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টায় এবং আমার ক্ষুদে বেতারকর্মী টীম গড়ে তোলার কাজে জনাব মাহবুব হাসানের সহযোগিতায় ব্যস্ত ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন আহমদও। পরে জেনেছিলাম, হান্নান সাহেব আমাদের কয়েকজন প্রকৌশলীকে অনুরোধ করে ট্রান্সমিটারে নিয়ে গিয়ে তাঁর ভাষণ প্রচার করেছেন। তবে তখন নিয়মিত কেন্দ্র পরিচালনার বা অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা রক্ষার কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। যদি হতো, সে সময়কার প্রকৌশলী বা অন্যান্য কর্মীদের সন্ধ্যায় আমি আমার দলের সাথে যোগ দিতে দেখতাম। তবে হ্যাঁ, জনাব হান্নান আমাদের অধিবেশন চলাকালেও স্বয়ং সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তাঁর মূল্যবান ভাষণ প্রচার করেছিলেন।’

বেতার কর্মীদের ভূমিকা : ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে বেতার কর্মীদের অনেকেই, যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকে কাজ করার ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ পরস্পর এমনও আলোচনা করেন যে, যদি অবস্থার কারণে প্রয়োজন হয় তা হলে একটা গোপন বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাজ করা গেলে তা আন্দোলনকে গতিশীল করতে সহায়ক হতো। এই ধরনের আলোচনায় বেলাল মোহাম্মদ (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন পান্ডুলিপিকার), আবুল কাসেম সন্দ্বীপ (ফটিকছড়ি কলেজের উপাধ্যক্ষ), আগ্রাবাদ হোটেলের ফারুক চৌধুরী, চট্টগ্রাম বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক আবদুল্লাহ ফারুক, চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠান (লোক গীতির লং প্লে ও চলচ্চিত্র নির্মাণ) তৈরি করতে আসা মাহমুদ হোসেন প্রমুখ সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

এর আগে অসহযোগ আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম বেতারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় সবরকম প্রচেষ্টা চালানোর অঙ্গীকার করেন। ৯ মার্চ বেতারের প্রোগ্রাম, নিউজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মী-প্রতিনিধিদের এক সভায় এই অঙ্গীকার করা হয় এবং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চট্টগ্রাম বেতার কর্মচারী পরিষদ নামে একটি সংগঠন করা হয়। ১১ মার্চ এক সভায় খন্দকার নজমুল আলমকে সভাপতি ও সৈয়দ আশরাফ আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠন করা হয় এ সংস্থার কার্যকরী পরিষদ। সভায় কেবল কিউশিট ছাড়া বেতারের সর্বস্তরে (দেশের ভেতর) বাংলা ভাষা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ এবং ২৬ মার্চ ভোর থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে বেলাল মোহাম্মদ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষে সমমনা লোকদের নিয়ে বেতার কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেন এবং বিভিন্ন জনের সঙ্গে দুপুর থেকে যোগাযোগ শুরু করেন। বিকেলের দিকে তারা আগ্রাবাদ বেতার ভবনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রে গিয়ে অনুষ্ঠান সংগঠনে ভূমিকা রাখেন। এ ব্যাপারে তিনি এনায়েতবাজারে ডা. মোহাম্মদ সফির (পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ) বাসায়ও সমমনাদের সঙ্গে বসে শলাপরামর্শ করেন। (চলবে)

মুহাম্মদ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট