চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হান্নান-জিয়ার উপস্থিতি ও স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পটভূমি

মুহাম্মদ শামসুল হক

২৭ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৫০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে (কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র, অবস্থান-বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের বিপরীতে) বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচার নিয়েও বেশ বিতর্ক ইতিমধ্যে হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে না তা বলা যায় না। একথা সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মূল ঘোষণাটি ওয়্যারলেস বা বেতারে প্রচারিত হওয়ায় আগেই চট্টগ্রামের ইপিআর বাহিনী তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। ক্যাপ্টেন রফিক বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এ ব্যাপারে গোপনে শলা-পরামর্শ করেন এবং এম আর সিদ্দিকী, ডা. জাফর প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যালও পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন রফিক-এম আর সিদ্দিকীর মাধ্যমে। তবে তাঁর প্রতি নির্দেশ ছিল ঢাকা থেকে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত আসার আগে যেন সরাসরি বিদ্রোহ তাঁরা না করেন। অন্য দিকে জিয়াউর রহমানও তাঁর জায়গা থেকে ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করেন এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে শলা-পরামর্শ করেন।

এরই মধ্যে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হওয়া এবং সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধ এবং চট্টগ্রাম মুক্ত করে কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে আওয়ামী লীগ তথা চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ক্যাপ্টেন রফিকও খবর পান যে ঢাকায় ইপিআর পুলিশ লাইনে পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করেছে। তিনি ডা. জাফর ও এম আর সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ করে সময় হাতছাড়া হবার আগেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর বাহিনীর মধ্যে থাকা এবং তাঁর জানামতে হালিশহর, পাহাড়তলীসহ অন্যান্য স্থানে অবস্থানরত পাঞ্জাবি সেনাদের নিরস্ত্র ও গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করে দেন।
পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবেলায় চলে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের রাজনৈতিক উদ্যোগ। এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত নেতাদের মধ্যে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ মান্নান, এম এ হান্নান, ডা. এম এ মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. জাফর আহমদ, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুণ চৌধুরী, মীর্জা আবু মনসুর ও শাহ-ই-জাহান চৌধুরী প্রমুখ। শুরু থেকে তাঁরা সবাই এক সঙ্গে এক জায়গায় বসে কাজ করছিলেন এমন নয়। একদল এম আর সিদ্দিকীর বাসভবনে, একদল আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবনে, আবার কেউ কেউ জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় এবং কেউ কেউ হাজারি গলিস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে বসে কৌশল নির্ধারণ করছিলেন। কারণ তখনকার সময়ে এখনকার মতো মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটের মতো সহজ কোনো যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। টিঅ্যান্ডটি টেলিফোনও ছিল খুবই সীমিত। এক এলাকা থেকে আর এলাকায় সংযোগ পেতে কখনো কখানো অপেক্ষা করতে হতো ঘণ্টারও বেশি সময়। এরই মধ্যে প্রত্যেক গ্রুপ অপর গ্রুপকে খোঁজ করে ঘটনাবলী পর্যালোচনা ও সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় কে, কখন, কার আগে, কার সঙ্গে, ঠিক কয়টায়, কার বাসায় বা কোন স্থানে দেখা পেয়েছিলেন, কার সঙ্গে কোন কথাটি হয়েছিল ঠিক কোন মুহূর্তে, তা সুনির্দিষ্ট বা স্পষ্টভাবে বলা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। তবে ইতিমধ্যে প্রকাশিত নানা তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এম আর সিদ্দিকীর বাসায় ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি ও এখানকার করণীয় বিষয় নির্ধারণের এক পর্যায়ে নেতাদের একদল তৎকালীন সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় যান। সেখানে আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে রাত আনুমানিক ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পেয়ে নেতাদের কেউ কেউ যান পাথরঘাটাস্থ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বাসা জুপিটার হাউসে। এম এ মান্নান ও এম এ হান্নান যান হাজারি গলির বিনোদা ভবনস্থ সিটি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। এ দুজায়গায় উপস্থিত ছাত্র ও যুব নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ঘোষণার বাংলা অনুবাদসহ প্রচুর পরিমাণ সাইক্লোস্টাইল কপি করিয়ে শহরময় শুরু করা হয় মাইকিং ও ঘোষণার কপি বিলি। ওয়্যারলেস কর্মী, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ ও সংগ্রাম পরিষদের সাথে যুক্ত মুক্তিকামী জনতার মুখে মুখে রাতের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। আর যে বা যারা ঘোষণার কপি পেয়েছেন তিনিই হয়তো মনে করেছেন এটি বোধ হয় তিনি বা তারাই আগে পেয়েছেন। এ অবস্থায় নেতা-কর্মীদের রাত কাটে নির্ঘুম। মধ্যরাতে অধিকাংশ নেতা-কর্মী জড়ো হন জুপিটার হাউসে। খোঁজ নিয়ে যতদূর জানা গেছে, আখতারুজ্জামান বাবুর বাসায় আলোচনার সময় অন্যদের মধ্যে এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, ডা. এম এ মান্নান এমপি, শাহ-ই জাহান চৌধুরী, মীর্জা আবু মনসুর, রাখাল চন্দ্র বণিক, আতাউর রহমান কায়সার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তখনো সবাই জানতেন না যে, বঙ্গবন্ধু কোথায় কি অবস্থায় আছেন।

সেখানে সিদ্ধান্ত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাটি বেতারের মাধ্যমে জনগণকে জানানো প্রয়োজন যাতে জনগণ হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে পারে। স্থির হয় যে, জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী ও এম আর সিদ্দিকীসহ চট্টগ্রামের তৎকালীন এমপিদের মধ্যে যাঁরা শহরে আছেন তাঁরা একযোগে বেতার কেন্দ্রে যাবেন এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পক্ষে জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণাটি বেতারে প্রচার করবেন। তবে পরবর্তীতে জহুর আহমদ চৌধুরী বেতার কেন্দ্রে যাননি। সকাল ৯টা ১০টার দিকে নেতা-কর্মীরা আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন (পরবর্তীতে মন্ত্রী) এবং আগ্রাবাদ থেকে আসা কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল হালিম। তাঁর হাতেও এলাকায় সকালে বিলি হওয়া স্বাধীনতার ঘোষণার একটি কপি ছিল যা তিনি এমএ হান্নানের হাতে দেন। তাঁরাসহ ডা. এমএ মান্নান, এম এ হান্নান, মীর্জা আবু মনসুর, ছাত্রলীগ নেতা শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, রাখালচন্দ্র বণিক প্রমুখ বেতার কেন্দ্রে পৌঁছেন বেলা প্রায় ১২টায়। আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা ততক্ষণে কাজ বন্ধ করে যার যার জায়গায় চলে গিয়েছিলেনÑরেডিওতে বাঙালিদের খবর না শোনার কারণে। হান্নান ও তাঁর সঙ্গীরা বেতার কেন্দ্রে কাউকে না পেয়ে খবর নিয়ে বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসির উদ্দিনকে তাঁর আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি থেকে ডেকে নিয়ে যান কালুরঘাট বেতার সম্প্রচারকেন্দ্রে।

প্রথমে মীর্জা নাসির উদ্দিনের বাসায় লোক পাঠানো হয় তাঁকে বেতারকেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে। কিন্তু তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পরবর্তীতে জবাবদিহি করতে হতে পারে এই ভয়ে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সেখানে কাস্টমসের কর্মকর্তা হালিমসহ স্থানীয় লোকজন নাসির সাহেবকে বুঝিয়ে, নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকটা জোর করে নিয়ে যান হান্নান সাহেবদের কাছে। আবদুস সোবহান নামে একজন রেডিও ইঞ্জিনিয়ারকেও নেওয়া হয় তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে কর্ণফুলী নদীর কাছাকাছি আগ্রাবাদ বেতারকেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান প্রচার করা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় সবাই ছুটে যান কালুরঘাটস্থ (বর্তমান বহাদ্দারহাট বাস টার্মিনালের বিপরীত দিকে) বেতার সম্প্রচারকেন্দ্রে। তাঁদের বহনকারী গাড়ির (নং চট্ট-খ-৪৫১৯৬৭) মালিক ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক প্রকৌশলী মো. আমিনুর রহমানের মতে, ২৬ মার্চ দুপুরে ট্রান্সমিটার চালু করতে যাওয়া প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, মীর্জা নাসির উদ্দিন এবং আবদুস সোবহানকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা (আমিনুর রহমান ও অন্য সহকর্মী) সাময়িক কন্ট্রোল রুম (টিঅ্যান্ডটি স্টোর কলোনিস্থ বাসা নং এফ-১/১) থেকে ৮০৮৭৮ নম্বর টেলিফোনে রাজনৈতিক নেতাদের জানিয়ে দেন। এরপর এম এ হান্নানের নেতৃত্বে রাজনৈতিক কর্মীরা তাদেরকে জোরপূর্বক বাসা থেকে তুলে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে নিয়ে যান। যাওয়ার সময় চকবাজারের বাদুরতলা এলাকা থেকে প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকেও সঙ্গে নেওয়া হয়। মোসলেম খান নামে অপর বেতার প্রকৌশলী রাতের শিফটে যাবেন বলে ঠিক হয়। বেলা প্রায় সোয়া দেড়টায় সবাই কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রে গিয়ে সম্প্রচার যন্ত্রটি চালু করার ব্যবস্থা করেন।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম পাঠ এম এ হান্নানের : বাস্তবতার দিক থেকে ২৬ মার্চ দুপুরে অনুষ্ঠানটি ছিল চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্ত ও অংশগ্রহণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম সূচনা। অনুষ্ঠানটির ঘোষক ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রাখালচন্দ্র বণিক। নিজের নাম প্রকাশ না করেই তিনি অনুষ্ঠান ঘোষকের দায়িত্ব পালন করেন। (চলবে)

মুহাম্মদ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট