চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্লাস্টিক দূষণ ও জনস্বাস্থ্যঝুঁকি

জহিরুদ্দীন মোঃ ইমরুল কায়েস

২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

প্লাস্টিকে প্লাস্টিকে সয়লাব পুরো দেশ। চট্টগ্রামও তার ব্যতিক্রম নয়। পরিবেশ ধ্বংসের জন্যে প্লাস্টিকের অপব্যবহারই যথেষ্ট। শহরের সামগ্রিক পরিবেশ নষ্টের জন্য একে অনেকাংশে দায়ী করা যায়। পানীয় বোতল, বিভিন্ন প্রকার চিপস্ এর খোসা, প্লাস্টিকের তৈরি প্লেট, চামচ, পানীয়ের গ্লাস, কাপ, কসমেটিকসের কৌটা, স্ট্র, কটনবাড ইত্যাদি দ্রব্যে টইটুম্বর আমাদের পথঘাট। এগুলোর সরব উপস্থিতিই বলে দেয় আমাদের দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার মোটেই কমেনি। শুধু ব্যবহারের ধরন পাল্টেছে। যেমন পূর্বে পলিথিন ব্যাগগুলো ছিল হাতলযুক্ত। এখন হাতলের বদলে আস্ত একটি পলিথিন। আগে বহনে সুবিধে ছিল। বর্তমানে বহনে কিঞ্চিত দৈন্যতা। ফারাক ঐটুকুনই! ঐটুকুন বাদ দিলে প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে আগের মতোই। ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যবহার মনে হয় আরো বেড়েছে।

আগে প্লাস্টিক ব্যাগের জন্য পয়সা খরচের দরকার ছিল। এখন আর তাও দরকার হয় না। পাঁচ টাকা দশ টাকার কাঁচা মরিচ কিনলেই শপিং ব্যাগ তথা প্লাস্টিক পলিথিন ফ্রি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিনামূল্যে পাওয়া একমাত্র পণ্য! বিনামূল্যে পাওয়া দ্রব্যের ব্যবহারতো বাড়বেই। বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে ৫৫ ম্যাক্রনের নিচে পাতলা পলিথিনের ব্যবহার ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছিল। চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন ১ কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। যার বেশির ভাগই ছুড়ে মারা হচ্ছে খোলা আকাশে। এগুলোর জায়গা হচ্ছে রাস্তা, নালা-নর্দমা হয়ে নদী। তারপর সাগর বা মহাসাগরে।

২০৫০ সাল নাগাদ মহাসাগরে মাছের চাইতে প্লাস্টিকের আধিক্য বেড়ে যাবে। প্লাস্টিকের আসলে নিশ্চিত মৃত্যু নেই এটি ‘অপচ্য পদার্থ’। পাঁচশত বা একহাজার বছর পরে প্লাস্টিকের চেহারা বিকৃতি হয়ে বা ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র হয়েও পানি বাতাসের সাথে মিশে থাকে। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূ-পৃষ্ঠীয় পানির সাথে মিশে যায়। এবং কালক্রমে ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠীয় পানি গ্রহণের সাথে সাথে তা আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। আর এভাবেই পানি গ্রহণের সাথে সাথে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। নানা ধরনের জৈব এবং অজৈব অ্যাডিটিভ বা যোজনীয় বস্তু ব্যবহার করে প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি করা হয়। এ্যাডিটিভের মধ্যে রয়েছে কালার‌্যান্ট ও পিগমেন্ট, প্লাস্টিসাইজার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, স্ট্যাভিলাইজার এবং বিভিন্ন ধাতু। কালার‌্যান্ট বা পিগমেন্ট জাতীয় পদার্থগুলো শিল্পজাত অ্যাজোডাইজ। প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগের রঙ উজ্জ্বল করার জন্য এই অ্যাজোডাইজ ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে বেশ কিছু পদার্থ হলো কারসিনোজিক বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী এবং এতে খাদ্যদ্রব্য বহন করা হলে তাতে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ বানানোর সময় ক্যাডমিয়াম বা সিসার মতো যে বিষাক্ত ধাতু মেশানো হয় তাও গলে গিয়ে খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কম মাত্রায় ক্যাডমিয়াম গ্রহণ করলে বমি বা হার্ট এনলার্জমেন্ট হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে সিসার সংস্পর্শে এলে তা মস্তিস্কের টিস্যুর ক্ষতি করতে পারে। রিসাইকেল করা রঙিন প্লাস্টিকগুলোতে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা চুইয়ে চুইয়ে মাটিতে প্রবেশ করে এবং ভূগর্ভস্থকে দূষিত করে।

পৃথিবীর বিলিয়ন বিলিয়ন প্লাস্টিক পণ্যের রিসাইকেল হয় মাত্র ৯%। ১২% প্লাস্টিককে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। আর বাকী ৭৯% প্লাস্টিক পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে দূষিত করছে। যে পরিমাণ প্লাস্টিক পুড়ানো হচ্ছে ঐ পরিমাণ প্লাস্টিকের ধোঁয়ায় থাকে বিষাক্ত গ্যাস। আর এ বিষাক্ত গ্যাস শরীরে প্রবেশ করে বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্যানসারের মতো ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় প্লাস্টিক পুড়ানোর দৃশ্য। প্লাস্টিক পুড়ানোর দায়ে কারো কোন শাস্তি হয়েছে বলে জানা যায় না। প্লাস্টিক পুড়ালে সালফার, নাইট্রোজেন জাতীয় বিভিন্ন গ্যাসের সঙ্গে কার্বন মনোক্স্রাইড তৈরি হয়। প্লাস্টিক যে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়, তা উন্মুক্ত পরিবেশে পুড়ালে ডাইঅক্সিনক্স নামক একটি বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয়। যা থেকে ক্যানসারের মতো মারণব্যাধী রোগ তৈরি হওয়া সম্ভাবনা থাকে। এমনকি প্লাস্টিক পুড়ে যে সব বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয় তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিক রক্ত দূষিত হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সেজন্য প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকবিহীন বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা উচিত। বাংলাদেশে প্রকাশ্যে প্লাস্টিক পুড়ালে কোন শাস্তির বিধান আছে কিনা তা জানা নেই। না থাকলে জনস্বার্থ বিবেচনায় এটি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্লাস্টিক এবং এর বর্জ্য সকল প্রাণীর জন্য স্লো পয়জনিং। এটি তিলে তিলে মানুষসহ সকল জীবকে ধ্বংস করে। সকল প্লাস্টিকই মানবদেহের জন্য খারাপ। একটু খেয়াল করলে দেখবেন প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্যের গায়ে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন থাকে। ত্রিভূজাকৃতির এসব সাংকেতিক চিহ্নে সাধারণত ১ থেকে ৭ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ১, ২, ৪, ৫ সংখ্যার প্লাস্টিকগুলো বাকী ৩, ৬, ৭ সংখ্যার চাইতে তুলনামূলক স্বাস্থ্যকর বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে সকল প্লাস্টিক দ্রব্যই পরিহার করা উচিত। কোন প্লাস্টিক পণ্যে এ ধরনের সিম্বল না থাকলে বুঝে নিতে হবে পণ্যটি আর্ন্তজাতিক মান রক্ষা করে তৈরি হয়নি। প্লাস্টিক জারে ওভেনে দিয়ে বা অন্য কোন ভাবে খাবার গরম করা হলে প্লাস্টিক দ্রব্যের রাসায়নিক পদার্থ দেহে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন করতে পারে।

গত ২৭শে মে ২০১৮ ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুধু একবার ব্যবহার হয় অর্থাৎ ‘ইউজ এন্ড থ্রো’ প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার প্রস্তাব গ্রহণ করেেছ। ২৮টি সদস্য রাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সংসদকে এ খসড়া পাস করতে হবে। এটি পাস হলে ইউরোপীয় অঞ্চলে একবার ব্যবহৃত হওয়া এমন প্লাস্টিক দ্রব্যের প্রচলন দ্রুত হ্রাস পাবে। ফোর্বস সূত্রে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে ‘একবার ব্যবহারযোগ্য’ প্লাস্টিক পণ্যের বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে এরকম ৩৪৯টি ছোট বড় শহরে এমন প্লাস্টিক ব্যবহার করার নিষেধ আছে অথবা ব্যবহার করতে হলে প্রচুর ট্যাক্স প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরকম আরো কিছু দেশ প্লাস্টিক পণ্য বন্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য ২০০২ সালে প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম দেশ হয়েও শুধুমাত্র আইন ব্যবহারের শৈথিলতার কারণে পলিথিন ব্যবহার বন্ধে তেমন সাফল্য লাভে সমর্থ হয়নি। আসুন এই আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলাদেশ থেকে সকল ক্ষতিকারক পলিথিন ব্যাগসহ অন্যান্য প্লাস্টিকদ্রব্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট