চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রাক-প্রাথমিকের আনন্দময় শিক্ষা

তাহমিনা শারমিন

৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আনন্দহীন শিক্ষা শিক্ষা নয়। যে শিক্ষায় আনন্দ নেই সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না’। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা কখনো প্রতিযোগিতাও হতে পারে না। শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করার আগে শিশুর অন্তর্নিহিত অপার বিস্ময়বোধ, অসীম কৌতুহল, আনন্দবোধ ও অফুরান উদ্যম সৃষ্টি করা জরুরি। শিক্ষাগ্রহণের শুরুটা খুবই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ।

একেবারে জীবনের শুরু থেকে সার্বজনীন মানবিক বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশ এবং প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব ইতোমধ্যেই সবার কাছে দৃশ্যমান। শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে আনতে এবং ঝরেপড়া রোধের মতো চ্যালেঞ্জিং ব্যাপারকে মাথায় রেখে সরকার এ শিক্ষা কার্যক্রমকে জাতির সামনে এনেছে। প্রাক-প্রাথমিকের আনন্দময় শিক্ষা শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় বিমুখতা রোধ করবে।

২০১৩ সালে আলাদাভাবে শিক্ষক নিয়োগদানের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এটা প্রাথমিক শিক্ষার ভিতকে আরো শক্ত করেছে নি:সন্দেহে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর সুপারিশের ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর পূর্বেই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষারব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে। পরবর্তীকালে এটি চার বছর বয়স থেকে দুই বছর মেয়াদে সম্প্রসারিত করা হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা যেমন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকসহ উচ্চতর শিক্ষার ভিত্তিমূল তেমনি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাও প্রাথমিক শিক্ষার ‘বিশেষ ভিত্তিমূল’। শিশুর শিক্ষাগ্রহণের সূচনালগ্নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে প্রাথমিক শিক্ষা। এখন রাখছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। এক গবেষণায় জানা যায়, জন্ম থেকে আট বছর শিশুর বিকাশ ও শিখনের উপযুক্ত সময়। এই সময়ের শিক্ষা শিশুর পরবর্তী জীবনে পথচলার ভিত্তি স্থাপন করে এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে। তাই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্তমানে বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছে এ শিক্ষাকার্যক্রম। খেলাধুলার উপকরণ, রং বেংয়ের ছবি, বৈচিত্র্যময় নানা উপকরণে সাজানো প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাসরুম। নানা রং ও আকারে তৈরি অক্ষরগুলো আকৃষ্ট করে শিশুদের। আনন্দময় পরিবেশে খেলতে খেলতেই শুরু হচ্ছে পাঠাভ্যাস। একসময় বিদেশের স্কুলগুলোতে শিশুদের পাঠ শুরুর বিষয়ে এমন চিত্র দেখা যেতো, এখন আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এমন সুযোগ পাচ্ছে শিশুরা।

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন শিক্ষকদের হাতে চক-ডাস্টারসহ আর যে জিনিসটি থাকত তা হল বেত। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষকই বকতে ভালোবাসতেন; অপরাধ করলে মারধর তো আছেই। অভিভাবকরাও শিক্ষকদের মারধরের বিষয়ে আপত্তি করতেন না। বরং এটাকে সন্তানদের সুশিক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে আশীর্বাদ মনে করতেন। সেসব এখন অতীত। আজকাল বেতসহ শিক্ষক দেখা যায় না। বিদ্যালয়ে মারধরের সংস্কৃতি এখন নেই। শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়ার অংশ হিসেবেই সরকার এ সংস্কৃতি উঠিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষকরা পুরোমাত্রায় প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। প্রশিক্ষনে শিক্ষার্থীদের মনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের খেলতে খেলতে শিক্ষা গ্রহণকে নিশ্চিত করার বিষয়ের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। এদিক থেকে বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীরা অনেকটাই ভাগ্যবান। শুধু বেতের বাড়ির জন্য কত শিক্ষার্থী যে পড়ালেখা থেকে ঝরে গেছে, সে হিসাব সম্ভবত কোনোদিনই জানা যাবে না। প্রচলিত বিদ্যালয়-ব্যবস্থা নিরানন্দময়। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন লেখায়ও সেটা আমরা দেখতে পাই। দেখা গেছে, পাঠদান আনন্দদায়ক হলে শিশুরা নিজে থেকেই শিক্ষা অর্জনে আগ্রহী হয়ে উঠে। প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য ক্লাসরুম আনন্দদায়ক করতে কক্ষটি ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো কল্পনা ব্লক, বই ও আঁকা ব্লক, বালি ও পানি ব্লক এবং নাড়াচাড়া ব্লক।

কল্পনা ব্লকে থাকে শিশুদের কল্পনাশক্তি বাড়াতে চিত্রাঙ্কন ও প্রদর্শনী, বই ও আঁকা ব্লকে থাকে গল্পের বই, ছড়া ও কবিতা এবং সেসব থেকে আঁকা আঁকি করা, বালি ও পানি ব্লকে শিশুরা বালি ও পানি দিয়ে নানা আকৃতি তৈরি করা এবং এগুলোর নাম শেখা এবং নাড়াচাড়া ব্লকে বিভিন্ন খেলনা, জ্যামিতিক বিভিন্ন আকৃতির উপকরণ নিয়ে নাড়াচাড়া বা খেলাধুলার সাথে সাথে নাম শেখা। এসবের সাথে সাথে শিশুদের শরীরচর্চা, ছোট-বড়, বিপজ্জনক বস্ত, বিভিন্ন রং, প্রাণী, ফল-ফসল, নদী, পুকুর, ইত্যাদির নাম ও পরিচিতি শেখানো হয়। আবার প্রতিটি ব্লককে নানা উপকরণ নানা রংয়ের অক্ষর, রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। নিচে কার্পেট বিছিয়ে তার উপর শিশুরা নিজের মতো করে বসা ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে।

তথ্য মতে, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ সাজাতে ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ হাজার টাকা দেয়া হয় সরকার থেকে। চলতি বছর থেকে দেয়া হচ্ছে ১০ হাজার টাকা করে। সরকার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর ফলে শিশুরা আনন্দের সাথে শিক্ষাজীবন শুরু করতে পারছে। ফলে শিশুদের স্কুলের প্রতি ভীতির পরিবর্তে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমে আসবে ধীরে ধীরে। দেশে শিক্ষা শুরুর প্রাথমিক ধাপ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উপর নজর দেয়া মানেই শিক্ষিত জাতি গঠনে একেবারে রুট লেভেল থেকে কাজ শুরু করা।

তাহমিনা শারমিন প্রধান শিক্ষক, হাছান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট