চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

নবীজীর অন্তিম দিনগুলো আল্লাহ’র দিদার লাভের ব্যাকুল করা তামান্না

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

নবীজীর অসুস্থতার সংবাদ জানার পর হতেই মদীনার আনসারগণ কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছিলেন। নবীজী এটা জানতে পেরে সাহাবাদেরকে ডেকে বললেন , ‘মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। কিন্তু আনসারগণ খাদ্যের মধ্যে নিমকের ন্যায় থাকবে। তাদের কোন ত্রুটি বিচ্যুতি হলে ওটা যেন উপেক্ষা করা হয়। রোগ বৃদ্ধি এবং শরীর ক্রমশ অধিকতর দুর্বল হতে থাকলেও নবীজী (স.) ১১দিন নিয়মিতভাবে মসজিদে গিয়েছিলেন। ওফাতের চারদিন পূর্বে বৃহস্পতিবারের দিনও মাগরিবের নামাযেও তিনি ইমামতি করেন। ইশার নামাযেও তিনি শরীক হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। শয্যা ছেড়ে যতবার উঠতে চেষ্টা করলেন ততবারই বেহুশ হয়ে পড়ে যান।

শেষবার চৈতন্য ফিরে আসলে তিনি বলেন, আবু বকর নামায পড়াবে। কিন্তু আবু বকর সেস্থানে হাজির না থাকায় নামায পড়াবার জন্য সকলে উমর (রোদি.)কে অনুরোধ করলেন। কিন্তু নবীজী পরপর তিনবারই বললেন , ‘আবু বকরই নামায পড়াবে’।
আবু বকর (রাদি.) নামায পড়ালেন। কিন্তু তাঁর কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল, পদদ্বয় কাঁপছিল এবং নবীজীর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এইরূপ আবু বকর (রাদি.) মোট ১৭ বেলা নামাযের ইমামতি করেছিলেন। একদিন নবীজী আবু বকর (রাদি.) এবং তাঁর পুত্র আবদুর রহমানকে ডেকে এনে একখানি ফরমান লিখাতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু উমর (রাদি.) বললেন অসুস্থ অবস্থায় নবী কারীম (স.)কে কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া কুরআন মজীদই যখন রয়েছে তখন আর কিছু বাকি নেই। নবীজীর ওফাতের দুইদিন পূর্বে আবু বকর (রাদি.) যোহরের নামায পড়াচ্ছিলেন, এমন সময় নবী কারীম (স.) এর মন সেদিকে আকৃষ্ট হয়। তিনি তৎক্ষণাত আলী (রাদি.) ও আব্বাস (রাদি.) এর কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে গমন করেন। মসজিদে তাঁর উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে নামাযরত মুসল্লিগণ নবীজীর দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে যান। আবু বকর (রাদি.)ও ইমামের আসন ত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। নবীজী তাকে ইঙ্গিতে নিষেধ করে তারই পাশে নামায পড়লেন।

ওফাতের একদিন পূর্বে নবীজী ৪০ জন গোলাম আযাদ করে দেন। তাঁর ভান্ডারে সেদিন সাতটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। তিনি বিবি আয়েশা (রাদি.) কে ডেকে বললেন- ‘ দুুনিয়ার ধন-দৌলত ঘরে সঞ্চিত রেখে আমি আমার প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করব, এটা খুবই লজ্জার কথা। তুমি দীনারগুলি দীন দু:খিদের মধ্যে বিতরণ করে দাও’।

বিবি আয়েশা (রাদি.) দীনারগুলিসহ গৃহের অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীও এমনভাবে দান করে দিয়েছিলেন যে , বাতি জ্বালানোর মত এতটুকু তেল পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিলনা। সন্ধার পর এক প্রতিবেশীর নিকট হতে তেল ধার করে এনে বাতি জ্বালাতে হয়েছিল। রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ (মতান্তর ১২ তারিখ) সোমবার সূর্যোদয়ের পর থেকে নবীজীর চেতনা ঘন ঘন লোপ পেতে থাকে। তাঁর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়তে দেখে ফাতিমা (রাদি.) কাঁদতে লাগলেন। নবীজী তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললেন , মা তুিম কেঁদনা। আমি চলে গেলে তোমরা শুধু বলবে ইন্নালিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ অতপর তিনি ফাতিমা (রাদি.) এর পুত্রদ্বয় হযরত হাসান ও হোসাইন (রদি) কে কাছে ডেকে এনে চুম্বন করেন। স্বীয় বিবিগণকেও তিনি সে সময় নানা উপদেশ দান করেছিলেন।
ক্ষণকাল পরে হযরত আবু বকর (রাদি.) এর পুত্র আবদুর রহমান (রাদি.) একখন্ড নতুন মিসওয়াক হাতে সেখানে উপস্থিত হন। নবীজী একদৃষ্টে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নবীজী মিসওয়াক করতে চাইতেছেন বুঝতে পেরে বিবি আয়েশা (রাদি.) তার ভাইয়ের হাত হতে মিসওয়াকখানি নিয়ে ওটার একপ্রান্তে চিবিয়ে নরম করে নবীজীর হাতে দিলেন। হুজুর (স.) সুস্থ লোকের ন্যায় মিসওয়াক দিয়ে দাঁতগুলি আরো উজ্জ্বল করে নিয়েছিলেন।

এরপর নবীজী তিনবার হাতখানি উপরের দিকে উঠিয়ে ক্ষীণস্বরে — সেই প্রিয়তম বন্ধুকেই চাই’ উচ্চারণ করলেন। তৃতীয়বার উচ্চারণের পর তার মুবারক হস্তদ্বয় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। আয়েশা (রাদি.) তাড়াতাড়ি হুজুর (স.) এর মস্তক স্বীয় বক্ষে তুলে নিয়ে তাঁর হস্তপদ আস্তে আস্তে মালিশ করতে লাগলেন। রাসূল (স.) মৃদু স্বরে বললেন—হাত সরিয়ে নাও।’ মুহূর্তের মধ্যে নবীজীর মুবারক রুহ অনন্তের উদ্দেশ্যে তাঁর দেহ হতে নিষ্ক্রান্ত হল। ইন্নালিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।- নিশ্চয় আমরা সবাই আলাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারিই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো (২: ১৫৬)।

পবিত্র মাহে রবিউল আউয়াল মহানবী (স.) কে স্মরণ ও বরণের মাস। তিনি যে ত্যাগ ও তিতীক্ষা আদর্শ ও নিষ্ঠা জীবনে প্রদর্শন করেছেন তা আমাদের জীবনে প্রতিফলিত করার মধ্যেই প্রকৃত সফলতা। তিনি জীবনসায়াহ্নে ভোলেননি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। ভোলেননি সততার কথা। নিজের প্রচারিত আদর্শকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমল করে দেখিয়ে গেছেন। নামাযের ব্যাপারে, নামাযের জামাত কায়েমের ব্যাপারে এবং অধীনস্থ মানুষের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তিনি শেষ জীবনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আমাদের পরিণত বয়সের জন্য তার জীবনের শেষ দিনগুলো মহৎ আদর্শ হতে পারে। আমরা বয়স যতই বাড়–ক না কেন, মৃত্যুর ঝুঁকি যতই কাছে আসুক না কেন দুনিয়াকে ছাড়তে চাইনা। অথচ মহানবী শিক্ষা দিয়ে গেছেন, মানুষকে ক্রমাগত আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ার, দুনিয়া বিমুখতা অনুশীলনের, তাসবীহ তাহলীল তিলাওয়াত, যিকির আসকার, সালাত ও সালামে একান্তে মনোনিবেশ করার। এ মৌসুম আমাদের জীবনে হুজুরে আকরাম (স.) কে নতুন করে চেনার ও ভালবাসার পথ উন্মুক্ত করুক। এ কামনা আজকে।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট