চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়ে কারচুপি চাই দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ

৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০৭ পূর্বাহ্ণ

রেলওয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও গতি বাড়ছে না রেলের। লোকসান বন্ধের নামে দফায় দফায় ভাড়া বাড়ানো হলেও বাড়ছে না সেবার মান। বন্ধ হচ্ছে না লোকসানও। বরং লোকসানের অঙ্ক দিন দিন বেড়েই চলেছে। রেলওয়ের ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট যে এর জন্যে প্রধানত দায়ী তা নানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। কিন্তু কালোবিড়াল ধরার উদ্যোগ তেমন দৃষ্টিগোচর হয়নি। ফলে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট। সর্বশেষ গতকাল দৈনিক পূর্বকোণসহ কয়েকটি দৈনিকে ‘রেলের কোটি কোটি টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়ে ব্যাপক কারচুপি’ শীর্ষক যে অভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তাতে দুর্নীতি ও লুটপাটের ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে এসেছে। পুরো রেলব্যবস্থাপনায় যে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম চলছে, প্রতিবেদনটি তা তথ্যপ্রমাণসহ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এখন দুর্নীতিবাজ চক্রের বিরুদ্ধে রেল কর্তৃপক্ষ কি পদক্ষেপ নিচ্ছে তা দেখার অপেক্ষায় আছে দেশবাসী।

প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, রেলের কোটি কোটি টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ কেনাকাটায় ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলছে সব কেনাকাটা। নিজস্ব ওয়ার্কশপ থাকলেও নগরীর মোগলটুলি ও মাদারবাড়ির বিভিন্ন ওয়ার্কশপে রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হচ্ছে। বিদেশি বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে খোলাবাজারের ওয়ার্কশপে তৈরির যন্ত্রাংশ। জরুরি দেখিয়ে এলটিএম পদ্ধতিতে (লিমিটেড টেন্ডার মেথড) রেলের খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার নামে কোটি কোটি টাকার খরচ দেখানো হচ্ছে পূর্বাঞ্চল রেলে। এতে বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ টাকা যাচ্ছে কেনাকাটায় জড়িত সিন্ডিকেটের পকেটে। নিয়ম অনুযায়ী রেলের ব্যবহৃত পণ্য কেনার পর স্টোরে মজুদ করার কথা। স্টোরে দায়িত্বরত কর্মকর্তা পণ্যের গুনগত মান পরিদর্শন করে মজুদ করবেন। পরবর্তীতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করবেন। কিন্তু সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থ ব্যয়ে খোলাবাজারে তৈরি এসব যন্ত্রাংশ স্টোর রুমে রাখা ও গুনগত মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘুরেফিরে পছন্দের ঠিকাদার সিন্ডিকেটকে যন্ত্রাংশের চাহিদাপত্র দিচ্ছে পাহাড়তলী ওয়ার্কশপের কর্মব্যবস্থাপক (নির্মাণ) সাইফুল ইসলাম। আবার টেন্ডারে অনিয়ম ও সরকারি অর্থ অপচয় রোধে ইলেক্ট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) টেন্ডার সিস্টেম চালু থাকলেও পাহাড়তলী ওয়ার্কস ম্যানেজার জরুরি দেখিয়ে সবসময় পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে এলটিএম পদ্ধতিতে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ কেনাকাটা করেন। নিয়মানুযায়ী, ওয়ার্কস ম্যানেজারের যন্ত্রাংশ কেনাকাটার এখতিয়ার নেই। জরুরিভিত্তিতে কোন যন্ত্রাংশ কিনতে হলে স্টোর বিভাগ থেকে ‘স্টক আউট সার্টিফিকেট’ নিতে হয়। স্টোরের অনুমতি সাপেক্ষে ওয়ার্কস ম্যানেজার বাজেটের ২০ শতাংশ পণ্য কিনতে পারেন। কিন্তু প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুযায়ী ওয়ার্কস ম্যানেজার সে নিয়মও ভঙ্গ করেছেন। রেল কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে তিনি এমন অনিয়ম কীভাবে করলেন সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অডিটেও কেনো এমন অনিয়ম ধরা পড়লো না এতোদিন সে প্রশ্নতো আছেই।

উল্লেখ্য, পাহাড়তলী, সৈয়দপুর ও পার্বতীপুরে বাংলাদেশ রেলওয়ের তিনটি কারখানা আছে। কারখানাগুলো প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল রেলওয়ের লোকোমোটিভ, ক্যারেজ ও ওয়াগনের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ এবং আয়ুষ্কাল ঠিক রাখার পাশাপাশি গতিশীলতা বজায় রাখা। এছাড়া কারখানাগুলোতে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করার মেশিনও রয়েছে। এসব কারখানায় ট্রেন পরিচালনায় যাবতীয় যন্ত্রপাতি মেরামত করাসহ স্টিম রিলিফ ক্রেন ও দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত রেল কোচ, ওয়াগন ইঞ্জিন মেরামতের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হয়। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর বিশাল রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ছাড়াও সৈয়দপুর কারখানায় রেলের সব ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ করা হয়। সেখানেও ক্যারেজ, ওয়াগন ও লোকোমোটিভের এক হাজার ২০০ রকমের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। ইচ্ছে করলে সেখানেও খুচরা এসব যন্ত্রাংশ তৈরি করতে পারে পূর্বাঞ্চল রেল। কিন্তু লুটপাটের সুযোগ নিতে লোকবল সংকট, বাজেট স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব, পুরনো যন্ত্রপাতি এবং আধুনিক মেশিনারিজের অভাবসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে রেলওয়ে ওয়ার্কশপে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি না করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাইরের বিভিন্ন মানহীন ওয়ার্কশপ থেকে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ কেনা হচ্ছে। এতে দুর্নীতিবাজচক্রগুলো ‘আঙ্গল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে গেলেও লোকসান পিছু ছাড়ছে না রেলওয়ের।

দুর্নীতি ও লুটপাটের এমন চিত্র কোনো মতেই জনকাম্য নয়। জনগণের টাকায় চলা রাষ্ট্রের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় পরিণত হবে তা মেনে নেয়া যায় না। আমরা প্রকাশিত প্রতিবেদনকে সামনে রেখে দুর্নীতিবাজচক্রের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অভিযান ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চাই। জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসানের কবলমুক্ত করতে এর বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব ধরনের দৃর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে ইতোমধ্যেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। তাতে ব্যাপক জনসাড়া ও জনপ্রশংসা মিলেছে। রেলকে দুর্নীতিবাজমুক্ত করতেও এমন শুদ্ধি অভিযান জরুরি। আমরা আশা করতে চাই, সরকার এ বিষয়ে জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট