চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

যুবরাজনীতির প্রবক্তা শেখ ফজলুল হক মনি

দেবাশীষ পাল দেবু

৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০৮ পূর্বাহ্ণ

শেখ ফজলুল হক মনির মৃত্যুর পর প্রায় পয়ত্তাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে তবু তিনি বাঙালির হৃদয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবেই দ্বীপ্তমান। যদিও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির বর্ণাঢ্য জীবনের শতভাগ তুলে আনা সম্ভব নয়। প্রশ্ন থাকতেই পারে এতো বছর পরে এসে তাকে নিয়ে কলম ধরলাম কেন? উত্তর একটাই শেখ ফজলুল হক মনিকে নিয়ে আশানুরূপ তথ্যবহুল লেখা পায়নি এদেশের যুবসমাজ। দুঃখজনক হলেও সত্য, আবছা বা এলোমেলো লেখায় পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয় না প্রজন্মের মননে।

শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম শেখ নূরুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি। মা শেখ আছিয়া খাতুন বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। শেখ নূরুল হক ও শেখ আছিয়া খাতুনের তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি সবার বড় ছিলেন। শেখ ফজলুল হক মনির মা আছিয়া খাতুন ছিলেন চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। তারই ছোট ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মেহভাজন ভাগিনা হিসাবে নয়, ষাটের দশকের গোড়া থেকেই শেখ ফজলুল হক মনি নিজের মেধা ও অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা বলে দেশের ছাত্র ও যুবসমাজের কাছে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ঢাকা নবকুমার স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে এসএসসি, ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৬০ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ, ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ এবং ড. আলীম আল রাজী কলেজ থেকে আইন বিষয়ে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। শেখ ফজলুল হক মনি পেশায় একজন সাংবাদিক ছিলেন। তিনি রাজনীতি ও সাংবাদিকতাকেই প্রধান পেশা ও নেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারি তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তিনি ইংরেজি দৈনিক ‘বাংলাদেশ টাইমস’ ও ‘সাপ্তাহিক সিনেমা’রও সম্পাদক ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি বিনোদন ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক সিনেমা’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তাঁর সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক ‘বাংলাদেশ টাইমস’ প্রকাশিত হয়।

শেখ ফজলুল হক মনি একাধারে একজন লেখক ও কলামিস্ট ছিলেন। যেটা বেশিরভাগ নেতা-কর্মীর অজানা। তাঁর লেখা জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে ‘অবাঞ্ছিতা’ ছবি তৈরি হয়েছিল। তার রচিত গল্পগ্রন্থ ‘বৃত্ত’ ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সময়ে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দি পিপলস’ ও ‘বাংলার বাণী’তে তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। মৃত্যুপরবর্তী তাঁর লেখা কলামগুলো সংগ্রহ করে ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ নামে ফকীর আবদূর রাজ্জাক ও বিমল করের সম্পাদনা ও গ্রন্থণায় প্রকাশিত হয়েছে।

ছাত্রজীবন থেকেই শেখ মনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬০-১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সফল সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের নিকট থেকে সনদপত্র গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ জন্য তাঁর ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি মামলায় জয়লাভ করে ডিগ্রি ফিরে পান। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। এ সময় বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আরো আটটি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর উদ্যোগে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের এ বাহিনীকে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং এর নেতৃত্বে ছিল ১৯-সদস্যের কেন্দ্রীয় কমান্ড। প্রথমদিকে সেক্টর কমান্ডারগণ ভারতের ব্যারাকপুর, শিলিগুড়ি, আগরতলা ও মেঘালয় থেকে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনা করতেন। এ বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমদ, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। শেখ ফজলুল হক মনি মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেরাদুন পাহাড়ি এলাকায় এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মুজিব বাহিনী গঠন এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পর্কে মুজিবনগর সরকার অবহিত ছিল না। এ বাহিনী মুজিবনগর সরকারের প্রতি কোন আনুষ্ঠানিক আনুগত্যও প্রকাশ করেনি। ফলে মুজিব বাহিনী গঠনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের ভেতরে ও বাইরে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। এ মত পার্থক্য নিরসনকল্পে ডি.পি ধর ও জেনারেল মানেক শ’র ন্যায় ভারতের কতিপয় ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এবং মুজিব বাহিনীর নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতায় মধ্যস্থতা করেন। ভারত সরকার এ বাহিনীকে একটি সি-৪, একটি এন-১২ এবং একটি পুরাতন ডাকোটা বিমানসহ বেশ কিছু ট্রাক ও জীপ প্রদান করে। কারো কারো ধারণা মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সম্ভাব্য বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজন মোকাবেলার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। আবার অন্যদের মতে, মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট ছিল না বলে এবং আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশের কার্যক্রমে সন্ধিহান থাকায় সংগঠকরা মুজিব বাহিনী গঠন করেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মুজিব বাহিনী যুদ্ধ করেছে। তারা দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন এবং ঢাকার আশেপাশে বেশ কিছু দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে। মুজিব বাহিনীর সদস্যগণ গেরিলা রণকৌশলে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ছিল এবং তারা ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুজিব বাহিনী গঠনের ধারণার উন্মেষ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। সে সময় কতিপয় জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এটি একটি একাডেমিক চিন্তা হিসেবে লালিত হত। মুজিব বাহিনীর অগ্রণী সংগঠকরাই একসময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন এবং তাঁরাই ছিলেন ১৯৬৯ সালের এগারো দফা কর্মসূচির প্রবক্তা। তাঁরা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করেন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের পথে সার্বিক প্রস্তুতি সংগঠিত করেন। এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে শেখ মনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের প্রথম যুব সংগঠন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে যুব রাজনীতির সূচনা করেন শেখ ফজলুল হক মনি। এবং সে সময় তিনি প্রথম সংগঠনটির চেয়ারম্যান র্নিবাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠা করা সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় সংগঠনের পরিচিতি পেয়েছে। ব্যক্তি জীবনে দুই ছেলে সন্তানের জনক ছিলেন তিনি। একজন শেখ ফজলে শামস পরশ অন্যজন শেখ ফজলে নূর তাপস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপদগামী সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তস্বত্তা স্ত্রীও নির্মমভাবে নিহত হন। মাত্র ছত্রিশ বছর আয়ু পেয়েছিলেন এই ক্ষণজন্মা। এই অল্প সময়ে দাগ কেটে গেছেন পৃথিবীর বুকে।

দেবাশীষ পাল দেবু সাবেক ছাত্রনেতা ও যুবসংগঠক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট