চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় উদয়পুর ও তেপানিয়া ক্যাম্প

পূর্ব প্রকাশিতের পর

নাওজিশ মাহমুদ

৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:২৩ পূর্বাহ্ণ

রাত্রে গানের আসর বসতো। এক দোকানদার, মনে হয় নাম হারুন। তার গাওয়া সতিনাথ এবং জগন্নাথ মিত্রের গান ছিল আমাদের আনন্দের উপকরণ। সেই সাথে চটুল গান। অনেকে এই গানের তালে নাচানাচিও করতো। তবলা হিসেবে ব্যবহার হতো টিনের খাওয়ার প্লেট। এই আসরে মধ্যমণি ছিলেন রুশ্নি ভাই।

এখানে আসার পর শুনতে পাই বিএলএফের নামকরণ হয় মুজিব বাহিনী। এই ক্যাম্পে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর পুর্বাঞ্চল জোনের ঢাকা, কুমিল্লা এবং নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগামের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সকলে জড়ো হয়েছিল। সকলের উদয়পুর বা বাহিরে যেতে হলে অনুমতি নিতে হতো। যেহেতু মন্টু ভাই চট্টগ্রাম কলেজের, আমরা পাশেই ইন্টারমিডিয়েট কলেজের, তাই আমাদের ব্যাপারে নিয়ম-কানুন একটু শিথিল ছিল অর্থাৎ আমরা সুবিধাভোগী ছিলাম। যেহেতু এই ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশে ঢুকি। তাই তেপানিয়া ক্যাম্পের স্মৃতি এখনও বেশী উজ্জ্বল।

বিএলএফকে ৪টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। পূর্বাঞ্চল জোনের কমান্ডার ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। মূলত চট্টগ্রাম বিভাগ ছিল এই পুর্বাঞ্চলের আওতায়। তাঁকে সহযোগিতা করতেন আ শ ম রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন। চট্টগ্রামের দায়িত্বে ছিলেন (জেলা ও মহানগর) চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম, এ মান্নান। চট্টগ্রাম মহানগরের অনেকগুলি টিম কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত ইউকসুর সাবেক ভিপি প্রকৌশলী আবছার উদ্দিন মোহম্মদ আলীকে প্রধান করে কমান্ড পুনর্বিন্যাস করা হয়। চট্টগ্রাম জেলার জন্য কমান্ডার করা হয় ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে। চট্টগ্রাম জেলাকে তিনটি উপ-অঞ্চলে ভাগ করা হয়। সন্দ্বীপ সীতাকুন্ড ও মীরেরশ^রাই নিয়ে একটি উপ-অঞ্চল তার দায়িত্বে ছিলেন সাবের আহমদ আসগরী। রাউজান, হাটহাজারী ফটিকছড়ি নিয়ে এস এম ইউসুফ এবং রাঙ্গুনিয়া ও রাঙামাটি নিয়ে স্বপন কুমার চৌধুরী। সীতাকু- থানার বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন ইউসুফ সালাহ উদ্দিন, মীরেরশ^রাই থানার কমান্ডার ইরফানুল হক, সন্দ্বীপের রফিকুল ইসলাম। ফটিকছড়ির সরফুদ্দিন এবং হাটহাজারীর এস এম ফজলুল হক। রাউজানের প্রথমে নাজিম উদ্দিন এবং নাজিম মারা গেলে শওকত হাফিজ খান রুশ্নি। রাঙ্গুনিয়ার নুরুল আলম এবং রাঙামাটির কমান্ডার কে ছিলেন সঠিক জানা যায় নি। শেখ ফজলুল হক মনি এবং মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁদের বিরাট বাহিনী নিয়ে ভারতে মাউন্টেন ব্রিগেডের সাথে মিজোরামের দেমাগীরি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন। আমাদের সাথের মিরেশ^রাই সীতাকু-ের ও সন্দ্বীপের যোদ্ধাদের এক অংশকে দেমাগিরি অভিযানের জন্য বাছাই করা হয়। আর এক অংশকে সীতাকু-ের জন্য বাছাই করা হয়। ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি আইনুল কামাল এবং আবুল কালাম আজাদ তাঁদের নিজ থানা সীতাকু- চলে যান। তবে মীরেরশ^রাইয়ের বিএলএফ সদস্য বেশী হওয়ায় ওখানকার সদস্যরা দেমাগিরী এবং সীতাকু-ে সংযুক্ত হন। সন্দ্বীপে আমরা প্রায় ৭/৮ জন ছিলাম। আমি নিজে, হুমায়ুন কবীর, আবু জাফর মাহমুদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মহিউদ্দিন নামে দু’জন এবং হুমায়ুন স্বরূপ। আমদেরকে নিয়ে সাবের ভাই বসলেন কি করা যায়। আমাকে বললেন সন্দ্বীপকে দুটি কমান্ডে ভাগ করে দিচ্ছি, উত্তর ও দক্ষিণ। উত্তরে রফিক কমান্ডার দক্ষিণে তুমি কমান্ডার। মীজান ভাইয়ের খুব আগ্রহ ছিল, আমাকে অনুরোধ করলো রাজী হয়ে যেতে, কিন্তু আমি রাজী হইনি।

কারণ সন্দ্বীপে কোন যুদ্ধ নাই। আমি জন্মের পর থেকে সন্দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন। আমাদের গ্রুপের সকলে বয়সে এবং শিক্ষায় আমার থেকেও অনেক এগিয়ে। কেহ মাস্টার শেষ করেছে। কেউ মাস্টার পড়ছে। আমি ১৯৭০ সালে মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হেেয়ছি। কলেজ ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছি। এদেরেকে কমান্ড করা আমার জন্য ব্রিবত অবস্থায় পড়তে হবে। আমি সবিনয়ে অপারগতা প্রকাশ করলাম। রফিকের প্রতি আমাদের এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধ ও দুর্বলতা ছিল। আমি তাঁকে ব্রিবত অবস্থায় ফেলতে চাই নি। ফলে আমাদেরকে দুইভাগ করে আমাকে আর হুমায়ুন স্বরূপকে ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিমের জেলা হাইকমান্ডের সাথে সংযুক্ত করা হয়। এই জেলা কমান্ডের সাথে উপ-জোনাল কমান্ডার এস এম ইউসুফ বিশাল একটি গ্রুপ নিয়ে একসাথে ছিলেন। বাকীদের দেমাগিরি অভিযানে সংযুক্ত করা হয়। যাদেরেকে দেমাগিরি যাওয়ার জন্য বাছাই করা হয়, তাদেরকে মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) ব্ল্যাকবোর্ড এঁকে একদিন ব্রীফ করলেন। আমরা যেহেতু দেমাগিরী যাচ্ছি না। তাই আমরা এই ব্রীফিং অনুষ্ঠানে থাকতে পারি নি।

একদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতা সৈয়দ আহমদ রূমি তেপানিয়া পরিদর্শনে আসলেন। তার সাথে আগরতলায় চলে আসলাম আমি আর হুমায়ুন স্বরূপ। আগরতলায় সিনেমা দেখলাম এবং রাতে হোটেলে রুম বুক করে থাকতে গেলাম কিন্তু পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এর লোক চ্যালেঞ্জ করে বসলেন আমাদের পরিচিতি নিয়ে। পরে শ্রীধর ভিলা থেকে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্র লীগের সভাপতি আইউব বাঙালি ভাইকে এনে সে যাত্রায় উদ্ধার পেলাম।

তেপানিয়া স্কুলে গিয়ে দেখলাম সুন্দর ভবন। পাকা এবং ছাদ টিনশেড। যুদ্ধের সময় শুধূ বেড়ার ঘর ছিল। স্কুলের নাম হচ্ছে তেপানিয়া কলোনী হাই স্কুল। যুদ্ধের সময় কখনও এদিকে আসি নি। সেখানে প্রধান শিক্ষককে পেলাম না। বাকী শিক্ষকরা এলাকায় নতুন। যুদ্ধকালীন স্মৃতি কেউ জানে না। তেপানিয়া ক্যাম্পটিও কোথায় ছিল বলতে পারলো না। স্কুল কম্পাউন্ডে তেপানিয়া ব্লক রিসোর্স হল ঘরে এসে এক ভদ্রলোককে পেলাম। তাঁকে তেপানিয়া ক্যাম্পের খবর জিজ্ঞেস করলে, সেও বলতে পারলো না। তবে তার সামনে বসা এক তরুণ বললো, আমার বন্ধুর পিতার দোকান ছিল অনেক পুরানো সেই বলতে পারবে। মোবাইলে জিজ্ঞেস করলো, সে আছে কীনা। উত্তর আসলো তাঁর বন্ধুর পিতা ঘরেই আছে। একটু বসতে বলে সে আমাকে নিয়ে গেল একটি বাড়ীতে। পাকা ঘর তবে ফিনিশং এখনও স¤পন্ন হয় নি অথবা করতে পারে নি। আমাকে চেয়ার দিল বসতে। নিজে আসলো খালি গায়ে। অসুস্থ। নিজের নাম বললো গোপাল দেবনাথ। বৈষ্ণব। জন্ম ১৯৫২ সালে। বাবার নাম প্রাণ বল্লভ দেবনাথ। গোপাল বাবু বর্তমানে এ্যাডভোকেট ক্লার্ক হিসেবে কর্মরত আছে। তবে শরীর অসুস্থ। শ^াসকষ্ট। কষ্ট করে আমার সাথে কথা বলেছেন। জন্ম এখানেই। বাবার দোকান ছিল তেপানিয়া ক্যাম্পের পাশে রাস্তার উল্টা দিকে। বাবার দোকানের সাথে বসতো। মুক্তিযোদ্ধরা সবাই আসতো। আড্ডা দিত। চা খেতো। ক্যাম্প ছিল এসবির ইনস্পেকশন বাংলোর সামনে খালি জায়গায়। স্কুলের পাশে। এখনও কিছু অংশ খালি পড়ে আছে। বাকী অংশ দোকান ঘর উঠেছে। এখন এটি তেপানিয়া বাজার। সেই বটগাছগুলি এখনও আছে। পাতকুয়াটা নেই। পানি দূষিত হয়ে যাওয়ায় এটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সেখানে এখন বসতবাড়ী। পাশে একটি জেলা হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। ছবি তুললাম তেপানিয়া ক্যাম্প যেখানে ছিল। তখন দু’জন তরুণ নিতাই দাশ ও রতন দাশ আমার পরিচয় জানতে চাইলো। পরিচয় দেয়ার পর ওরা আবার জোর করে চা খাওয়ালো।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কোন চিহ্ন নেই। তবে শ্রিধর ভিলা, কলেজ টিলা, গ্লাস ফ্যাক্টরি, তেপানিয়া ক্যাম্প, হরিণা ক্যম্প, সাব্রুম ও বৈষ্ণবপুর প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি একদিন হারিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য আমাদের সরকার এবং মুক্তিযোদ্ধারা যদি এগিয়ে না আসে, তা হলে এই ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। সরকার এবং মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কিছুটা হলেও সংরক্ষণ করা যেতো। (সমাপ্ত)

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট