চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বেবী

মো. জামাল উদ্দীন

২৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:২৪ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর দেশে দেশে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারে যে মাধ্যম তা হচ্ছে রাজনীতি। অর্থাৎ সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নয়নে রাজনীতিই হচ্ছে মূল নিয়ামক এবং শিক্ষা হচ্ছে এর একটি প্রধানতম অনুষঙ্গ। আর এ অনুষঙ্গ শিক্ষার প্রসারে-উন্নয়নে সর্বোপরি জন-উন্নয়নে রাজনীতিকে যিনি যতো বেশি সফলতার সাথে কাজে লাগাতে পারেন, তিনিই হচ্ছেন তত সফল রাজনীতিবিদ।

সে অর্থে আলহাজ¦ শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বেবী একজন সফল রাজনীতিবিদ। সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম অনুষঙ্গ শিক্ষাকে তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজে লাগিয়েছেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি বুঝেছিলেন-শিক্ষা পাওয়া একজন মানুষের প্রতি রাষ্ট্র কিংবা সমাজের করুণা নয় বা শিক্ষা কোন সুযোগ নয় বরং শিক্ষা লাভ করা বা শিক্ষা পাওয়া প্রতিটি মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। শিক্ষাকে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্রজীবন থেকেই তিনি একজন সক্রিয় ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষার অধিকার আদায় আন্দোলনের কর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। স্বাধীনতাপূর্ববর্তী সময় থেকেই তিনি গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং একই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং বেবী ভাইয়ের মতো আরো অসংখ্য নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি অংশে ১৭ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে সার্বজনীন এবং অবৈতনিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে জনগণের সেই শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জনাব বেবী চৌধুরী জীবনের শেষ নি:শ^াস অবধি কাজ করে গেছেন।

এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই, তাঁর জীবনের এক অমর কীর্তি ‘সাজিনা চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়’। এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি তাঁর বৃহত্তর পরিবারের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, ছিটিয়া পাড়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকলের মধ্যে এ বিদ্যালয়ের ব্যাপারে ঐকতান সৃষ্টি করতে তিনি অন্যতম প্রধান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু সেই ঐকতানের সুর পুরোপুরি স্থায়ী রূপ লাভ করেনি, মাঝে মধ্যে ম্লান হয়ে যেতেও দেখেছি। আমি দেখেছি তাঁর ভগ্ন হৃদয়ের আকুতি। একদিন তিনি আমাকে অত্যন্ত বেদনার সাথে বলেছিলেন; জামাল সাহেব, আমি মনে হয় এ স্কুলটা আর চালাতে পারব না, ইদিলপুর থেকে যে সব ছাত্র-ছাত্রী আসে, তাদের যাতে কোন ভোগান্তি না হয় সে দিকটা বিবেচনা করে তাদেরকে আপনার স্কুলে ভর্তি করে নেবেন। অন্যদেরকে পাশাপাশি স্কুলে ভর্তি করে নেয়ার জন্য প্রধান শিক্ষক বৃন্দকে অনুরোধ করবো। সেদিন আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন- এক যুদ্ধাহত সৈনিকের পরাজয়।

আমরা জানি, মহান সৃষ্টিকর্তা যাঁকে ইচ্ছা সম্মান দেন এবং যাঁকে ইচ্ছা তার কাছ থেকে সম্মান কেড়ে নেন। আমরা দেখতে পাই, মহান সৃষ্টিকর্তা বেবী ভাইকে অসম্মানিত করেন নি; বরং আরো অধিকতর সম্মান প্রদান করেছেন। তাইতো আমরা দেখতে পাই, সেই বিদ্যালয়টির প্রাথমিক অবস্থায় এমনিতর ক্রান্তিকালে তাঁর ভাগ্নে জনাব ফরহাদ গণি নয়নকে তাঁর মামার আজীবনের স্বপ্ন, প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলকে পুনরুজ্জীবীত করার জন্য সর্বোপরি তার মামার সম্মান রক্ষার্থে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁকে তার মামার পাশে এনে দাঁড় করিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে আমরা বর্তমানে দেখতে পাই, বেবী ভাইয়ের বাড়ির পাশেই বিরাট আঙিনায়, বিশাল অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে-সাজিনা চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়। রাউজানের মাননীয় সাংসদ জনাব এ.বি.এম. ফজলে করিম চৌধুরীকে সাথে নিয়ে দৃষ্টিনন্দন এই বিদ্যালয়ভবনের ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের তৎকালীন মাননীয় উপাচার্য জনাব আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণে বেবী ভাই অত্যন্ত দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। এই বিদ্যালয়ের খোলামেলা আঙিনা শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাই শহরের নাগরিক সমাজের বেড়ে ওঠা একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর মতো এ বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক কিংবা অভিভাবকের নিকট প্রশ্ন করবে না- ধান গাছে তক্তা হয় কি না কিংবা দিনে কয়বার জোয়ার-ভাটা হয়। ফসলি মাঠ, খোলা প্রান্তর, বিদ্যালয়ের পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া বেরুলিয়া খাল এবং বটবৃক্ষ শোভিত এলাকায় কচি-কাঁচা র্শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত এ বিদ্যালয়টিকে দেখলে আমার মানসপটে কবিগুরুর শান্তি নিকেতনের একটি অবয়ব ভেসে ওঠে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন; “আসল শিক্ষা হচ্ছে এই তপোবনীয় শিক্ষা, যা শহরের কোলাহলে সম্ভব নয়। তাঁর মতে, শেখার বা বেড়ে ওঠার সময় প্রকৃতির সহায়তা চাই-ই চাই।”বেবী ভাইয়ের এ স্বপ্নের শিক্ষা নিকেতনটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সহযোগী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই জনাব ফরহাদ গণি নয়নকে। সাজিনা চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা।
বেবী ভাইয়ের আরেক প্রাণের প্রতিষ্ঠান ছিল রাউজান বিশ^বিদ্যালয় কলেজ। গভর্নিং বডির অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য হিসেবে এই কলেজকে বিশ^বিদ্যালয় কলেজে রূপায়ন, সর্বোপরি কলেজকে সরকারিকরণে মাননীয় সাংসদ এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীকে গ্রাউন্ড লেভেল থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছেন। শিক্ষার হার বিশ্লেষণ করলে রাউজান আজ সমগ্র চট্টগ্রামে প্রথম স্থান দখল করে আছে। এটা কোন কথার কথা বা আষাঢ়ে গল্প নয়। যে কেউ ইচ্ছা করলে চট্টগ্রাম শিক্ষা অফিস থেকে এ তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেন।

রাউজানের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং শিক্ষকদের সাথে জনাব বেবী চৌধুরীর আত্মিক সম্পর্ক ছিলো। যে কেউ তার যে কোন সমস্যার কথা নি:সঙ্কোচে বেবী ভাইয়ের নিকট ব্যক্ত করতে পারতেন এবং তিনি তাঁদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন। শিক্ষকদেরকে তিনি সবসময় উঁচু মর্যাদায় রাখতেন। উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষকদের যে কোন কর্মসূচিতে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হলে, তিনি নিশ্চিত ভাবে উপস্থিত থাকতেন এবং সর্বোতভাবে শিক্ষকদের সাথে একাত্মতা পোষণ করতেন। শিক্ষা নিয়ে তিনি তাঁর মতামত-ধ্যান ধারণা সকলের সাথে খোলামেলা ভাবে আলোচনা করতেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন একজন শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব দরদী জন।
বিভিন্ন সময়ে তিনি রাউজান উচ্চ বিদ্যালয়, সুরেশ বিদ্যায়তনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন এবং দক্ষতার সাথে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রয়াণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি রাউজান ছালামত উল্লাহ্ উচ্চ বিদ্যালয় এবং সাজিনা চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

সুলতানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের যেকোন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ, সহযোগিতা প্রদান করতেন। ‘সুলতানপুর’ একটি ঐতিহ্যবাহী শব্দ। রাউজানের তৎকালীন ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫ নং ইউনিয়নের নাম ছিল সুলতানপুর। রাউজান উপজেলা সদরও এই ইউনিয়নের মধ্যে অবস্থিত। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে রাউজান তথা সমগ্র চট্টগ্রামে সুলতানপুর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বর্ষীয়ান লোকেরা মুখে মুখে বলতেন, বাঁশখালীর কালীপুর, ফটিকছড়ির নানুপুর, রাউজানের সুলতানপুর এ তিনটি এলাকা সমগ্র চট্টগ্রামে বিশেষ ঐতিহ্যম-িত এলাকা হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু রাউজান পৌরসভা গঠিত হওয়ার পর সুলতানপুর ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে। ফলে কাগজে-কলমে সুলতানপুর শব্দটি এখন বিলুপ্ত-প্রায়। কিন্তু এ সুলতানপুর শব্দটিকে অত্যন্ত জোরালোভাবে ধারণ করে রেখেছে ‘সুলতানপুর উচ্চ বিদ্যালয়’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। এমপি মহোদয়কে সাথে নিয়ে সুলতানপুর উচ্চবিদ্যালয় আয়োজিত বার্ষিক পুরস্কার বিতরণ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জনাব বেবী চৌধুরী অত্যন্ত আবেগের সাথে উপরিউক্ত কথাগুলো বলেছিলেন এবং এই সুলতানপুরের ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য তিনি বিদ্যালয়ের কঁচি-কাঁচা শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অনেক অসহায় এবং আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন। যা থাকত একদম লোকচক্ষুর আড়ালে। কিন্তু তাঁর প্রয়াণের পর ঐ সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা যারা আজ সমাজে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত তারা অশ্রুসিক্ত নয়নে, শোকাতুর হৃদয়ে পরম কৃতজ্ঞতার সাথে বেবী ভাইয়ের সহযোগিতার কথা স্বীকার করছেন। জীবদ্দশায় বেবী ভাই যা কাউকে জানতে দেননি, এমন কি পরিবারের সদস্যদেরকেও নয়।

২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিকুল ইসলাম চৌধুরীর বেবী ভাই আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর রাউজান কলেজ মাঠে তাঁর নামাজে জানাযায় এতো প্রচুর সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ছিল অভূতপূর্ব। আর এ উপস্থিতি জানান দিয়েছে, রাউজানের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে তিনি কত প্রিয় জন; কত আপন জন ছিলেন।
আমার ভাবতেও অবাক লাগে, একজন মানুষ, একজন বেবী চৌধুরী কিভাবে সকল দল, মত, পথের মানুষের কাছে সমানভাবে এতোটা গ্রহণযোগ্য হতে পারেন। এই সার্বজনীনতাই ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা একজন প্রকৃত শিক্ষানুরাগী এবং দরদী মানুষকে হারালাম। কীর্তিমানের মৃত্যু নাই। বেবী ভাইও তাঁর কৃতকর্মের মধ্যদিয়ে রাউজানবাসীর হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। পরিশেষে, পরম করুণাময় তাঁকে জান্নাতবাসী করুন-এই প্রার্থনাই করি। একই সাথে, শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বেবী সমগ্র রাউজানে শিক্ষার প্রসারে-উন্নয়নে এবং শিক্ষাকে গণমানুষের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যে ভূমিকা পালন করে গেছেন তাঁর পরিবারের উত্তরসূরীরাও যেন তাঁর সেই কাজের ধারা অব্যাহত রাখে, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

মো. জামাল উদ্দীন প্রধান শিক্ষক, সুলতানপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট