চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বাসের কীর্তিমান মানুষ

সাখাওয়াত হোসেন মজনু

২৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা, মানবকল্যাণ এবং সময় উপযোগী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য চট্টগ্রামের একজন মানুষ আমৃত্যু জীবনসংগ্রাম করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সমাজটা, দেশটা মানুষের জন্য নিবেদিত হোক। ধর্মটা নিজের একান্ত চেতনার বিষয় এবং এর মূল আদর্শ যেন সার্বজনীনতা পায়- এমন চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী মানুষটির নাম মনীষী মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। জনমুখে তিনি পরিচিত ছিলেন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী নামে। বোধকরি একসময় চট্টগ্রামের নাম ছিলো ইসলামাবাদ। চট্টগ্রামের প্রকৃতি এবং সামাজিক অবস্থানকে নিজের মধ্যে নিত্য ধারণের মানসিকতায় তিনি নিজের নামের সাথে ইসলামাবাদী যুক্ত করেছিলেন।

এ প্রজন্মের সামনে তাঁর পরিচিতি কেমন? সত্য বললে বলতে হবে তিনি এখনো তেমন পরিচিত নন। কারণ সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশ হচ্ছে সত্য কিন্তু এইসব মনীষীদের চর্চার আওতায় তেমন আনা যাচ্ছে না বা আনা হচ্ছে না বলে ইতিহাস সমৃদ্ধ চাটগাঁইয়া এই মনীষী স্মৃতির অন্তরালেই এখনো। শুধু কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা নিয়ে আলোচনা হলেই তিনি আলোচনায় আসেন। এর বাইরে তিনিতো চর্চার বিষয় হন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় চর্চার নেপথ্যে রাজনীতি বা আত্মপ্রচার। ফলে প্রকৃত মানুষের কাছে গবেষণা বিষয়গুলোর মধ্যে নেতিবাচক অবস্থা বিদ্যমান। এর বিপরীত চিত্রও আছে। তবে তা সামান্য। তাঁকে যখন মূল্যায়নের অধ্যায়ে আনার চেষ্টা হয় তখন মনে পড়ে চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াসের বিখ্যাত একটি উক্তির কথা। তিনি শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছিলেন।

ওভ ুড়ঁৎ ঢ়ষধহ রং ভড়ৎ ড়হব ুবধৎ- চষধহঃ জরপব.
ওভ ুড়ঁৎ ঢ়ষধহ রং ভড়ৎ ঃবহ ুবধৎং- চষধহঃ ঞৎববং.
ওভ ুড়ঁৎ ঢ়ষধহ রং ভড়ৎ যঁহফৎবফ ুবধৎং- ঊফঁপধঃব ঢ়বড়ঢ়ষব.
দার্শনিক কনফুসিয়াসের এই উক্তিটি ছিলো সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শিক্ষাই হচ্ছে একমাত্র মাধ্যম যার মাধ্যমে মানুষ এবং সভ্যতা এগিয়ে যায়। পারিবারিক শিক্ষার আলোকে এবং নিজের জ্ঞান বিকাশের শিক্ষায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মানুষকে সমাজ উপযোগী করে গড়তে হলে একমাত্র শিক্ষাই মূল এবং মৌলিক হাতিয়ার। নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা এবং স্বজন পরিজন নিয়ে বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম ছিলো তাঁর ধ্যান জ্ঞানের অঞ্চল। টহরঃবফ ওহফরধ- এই কনসেপ্টের ধারক মাওলানা সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন এই অঞ্চলের মানুষজন শিক্ষায় পিছিয়ে। ধর্মীয় কুসংস্কারে তারা নিমজ্জিত। তাই তিনি ভাবলেন দার্শনিক কনফুসিয়াসের দর্শনকে বাস্তবায়ন করা না গেলে এই অঞ্চলের মানুষদের জীবনের মৌলিক চেতনায় কখনো ফিরিয়ে আনা যাবে না। এই চিন্তার আলোকে তিনি সর্বপ্রথম ভাবলেন নিজ ধর্মের মৌলিকত্বকে শিক্ষায় স্থাপন করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে মুসলমান এবং ইসলাম হচ্ছে প্রগতির, কুসংস্কার মুক্ত, শিক্ষায় তাঁরা অগ্রগামী। এই বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তিনি প্রাচীন যুগের দেয়াং পরগনার বিশেষ পাহাড়ী অঞ্চলের স্থান দেয়াং পাহাড় বন্দোবস্তী নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল- ১। আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। ২। মুসলমান সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা। ৩। ভারতীয় সমাজ মুসলমানদের সমাজ উপযোগী করা। ৪। চট্টগ্রামকে বিশ্ব দরবারে সম্মানজনক স্থানে উপস্থাপন করা।
প্রশ্ন উঠেছিলো মাওলানা কেন আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য দেয়াং অঞ্চলটিকে বেছে নিয়েছিলেন? হ্যা এমন প্রশ্ন এখন উঠছে। প্রথমে বলতে হয় দেয়াং অঞ্চলের কথা। এখনো আমরা ভালো করে চিনি না কোথায় সেই দেয়াং অঞ্চল? সংক্ষিপ্ত তথ্য হচ্ছে কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গপোসাগরের কোল ঘেঁষে এই পাহাড়ী দেয়াং অঞ্চল। চট্টগ্রামের আনোয়ারার শেষ উত্তরাংশে। এখন পুরো কোরিয়ান ই পি জেড এবং সাথে মরিয়ম আশ্রমকে নিয়েই বিশাল সমতল ও পাহাড়ী এলাকা নিয়ে দেয়াং পাহাড় অঞ্চল।

বিশাল এই স্থানকে বেছে নেয়ার মূল কারণ ছিলো বড় মাপের শিক্ষা কমপ্লেক্স গড়ে তোলা। যদিও তার স্বপ্ন সফল হয়নি। কিন্তু

এখনো তাঁর সে চেতনা বিলীন হয়ে যায়নি। এছাড়াও ছিলো নৌযোগাযোগের ভাবনা। গবেষকের মন নিয়ে সেখানে গেলে এবং মাওলানার আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবনা নিয়ে চিন্তা করলে স্পষ্ট হবে তিনি কতোটা দূরদর্শী চিন্তা চেতনার মানুষ ছিলেন। তিনি ধর্মভীরু মানুষ ছিলেন। তবে ছিলেন না ধর্মান্ধ। নিজের সম্প্রদায়ের কথা ভাবতেন তবে সাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন না। আরবি বিশ্ববিদ্যালয় করার ইচ্ছা ছিলো দু’টি কারণে। ১ম কারণ: ইসলামের মূল নির্যাস গবেষণায় বের করে সর্বমহলে প্রচার। ২য় কারণ: ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ তৈরি করা যেন সৃষ্টি হয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। ভাবনার বিষয় হচ্ছে মুসলমান ও প্রকৃত মুসলমান করা এবং প্রকৃত ইসলাম কি? প্রকৃত ইসলাম যাঁরা ধারন করেন তাঁরাই প্রকৃত মুসলমান। কখনো হিংসাশ্রয়ী হয় না। সৎ চিন্তা, সৎ ধ্যান, সৎ জীবনাচারই তাঁদের মুখ্য জীবন। ইসলামের এই মৌলিক বিষয়গুলোই ছিলো তাঁর প্রাণের মূল উদ্দেশ্য। তিনি জানতেন চট্টগ্রামের মাটিতে এসেছিলেন ইসলামী প্রচারক দল। চট্টগ্রাম ছিলো সে জন্য পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের স্থান এবং পবিত্রও বটে। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী দর্শনে বুঝতে পেরেছিলেন মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি’র সেই বক্তব্যটি যার মাধ্যমে একজন মানুষ মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে যেতে পারেন। জালাল উদ্দিন রুমি বলেছিলেন।

‘জায়নামাজ আর তসবিহ্ জপে, খোদ খোদা ভুলছেন না,/ মানব সেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গ দুয়ার খুলবে না।’
স্বর্গের দুয়ার খুলতে হলে মূল এবং মৌলিক কাজ হচ্ছে মানুষের সেবা করা। আমাদের চট্টগ্রামের জ্ঞানতাপস মাওলানা সেজন্যই বেছে নিয়েছিলেন ক্ষেত্র হিসেবে এতিম সন্তানদের। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এতিমদের খুব বেশি ভালোবাসতেন। তিনি নিজেও এতিম ছিলেন। তাই এতিম মনের ভাবনাগুলো নিজেকে দিয়েই আত্মস্থ করেছিলেন।

এই জন্যইতো মাওলানা প্রতিষ্ঠা করলেন কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা। এখনো অনেকে বলেন, তিনি মোমিন রোডে প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার নাম স্থানের নামে না দিয়ে কদম মোবারক কেন দিলেন? আমরা অনেকে জানি ‘কদম মোবারক’ কেন নামকরণ হলো? এই মসজিদে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা (সা.) এবং হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র.আ.) এর পবিত্র কদম বা পায়ের ছাপযুক্ত নিদর্শন রয়েছে। সে জন্যই ‘কদম মোবারক’ নামকরণ হয়েছে। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সেই অক্ষয় বিষয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার নাম কদম মোবারক এতিমখানা রেখেছিলেন। সময়ের সাহসী সন্তান মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী একটি নাম, একটি বিস্ময় এবং একটি চেতনার স্মৃতির পাতায় পবিত্র মানুষ। তাঁকে চর্চা করা, গবেষণা করা প্রয়োজন সুন্দর মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য।

সাখাওয়াত হোসেন মজনু
গবেষক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট