চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

আমাজন অরণ্য রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হতে হবে

জহিরুদ্দীন মো. ইমরুল কায়েস

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর ‘সবুজ ফুসফুস’ খ্যাত আমাজন অরণ্য বিশ্বের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্য সম্পন্ন এক গভীর বন-বাদাড়। সমগ্র পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২৫ ভাগ যোগান দেয় এই আমাজন। ৭০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই অরণ্যের প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকাটি মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। নয়টি দেশ জুড়ে এই জঙ্গলটি বিস্তৃত। পৃথিবী জুড়ে যে গভীর রেইনফরেস্ট রয়েছে তার অর্ধেকটা হল এই অরণ্য। এই আমাজনে রয়েছে ১৬০০০ হাজার প্রজাতির ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ এবং বহু প্রাণীকূলের মহাসমাবেশ। অসংখ্য ঔষধ তৈরির কাজে আমাজনের গাছ-গাছালি ব্যবহৃত হয়। ক্যানসার, হার্ট এবং জঠিল রোগের ঔষধ প্রস্তুতিতে আমাজনের শেকড়-বাকলের বিকল্প নেই। কিন্তু পৃথিবীর এই মহামূল্যবান সম্পদটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মনুষ্যসৃষ্ট প্রাণঘাতী আচার-আচরণে নিষ্পাপ এই অরণ্যটি জ্বলে-পুড়ে ছাড়খাড় হচ্ছে। ভেবে দেখুন এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত শুধু ব্রাজিলের আমাজন অংশে আগুনের ঘটনার সংখ্যা ৪০,০০০।

বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে এবং পেরুতে সংঘঠিত হয়েছে যথাক্রমে আরো ১৯,০০০, ১১০০০ এবং ৬,৭০০ বার আগুনের ঘটনা। ব্রাজিলের উত্তরের রোরাইমা, একর, রন্ডোনিয়া এবং অ্যামাজোনাস রাজ্যগুলো খুব বিশ্রীভাবে পুড়ে গেছে। শুধু ২০১৯ সালের সৃষ্ট আগুনে ব্রাজিলের আমাজন অংশে ধ্বংস হযেছে ৯ লক্ষ ৬ হাজার হেক্টর অরণ্য। এই আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত আমাজনের ব্রাজিল অংশে আগুন লাগার সংখ্যা আরো ৯০০০! গেল বছর গুলোর তুলনায় এবার আমাজনে আগুনের ঘটনা ৭৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। কী এক অবিশ্বাস্য চিত্র! আমাজনের লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা যাচ্ছে মহাকাশ থেকেও। রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেছে ব্রাজিলের দিন দুপুরের আকাশ! আগুনের প্রকোপ এতটাই বেশী যে, আমাজন থেকে ২৭০০ কিলোমিটার দূরের শহর সাও পাওলোর আকাশও নিস্তার পায়নি। মিনিট প্রতি ০৩টি ফুটবল মাঠের সমান অরণ্য উজাড় হচ্ছে আমাজনে। শুধূ এ বছরের জুলাই মাসে ধ্বংস হওয়া জঙ্গলের পরিমাণ ৫১৯ বর্গমাইল। এ এলাকা কিনা টোকিও শহরের দ্বিগুণ!

কৃষি ভূমি, গবাদী পশু চারণ ক্ষেত্র কিংবা খনি খননের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বন দস্যুরা ‘সø্যাশ এন্ড বার্ন’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। আগুন সবসময় অরণ্যের কিনারে লাগানো হয়। এখন রীতিমত বোলডোজার এবং বড় বড় ট্রাক্টর ব্যবহার করে গভীর বন জঙ্গল সাবাড় হচ্ছে। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্রাজিলে ৭.৭৭ কোটি হেক্টর অরণ্য কেটে ফেলা হয়েছে। যা মোট আমাজনের ১২% শতাংশ। আমাজনের এ বৃহৎ অংশকে তারা গো চারণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে উজাড় করা অংশের প্রায় ৮০% জায়গায় গবাদী পশু পালন হয়। বড় জীব জন্তুর চাইতে আমাজনে ছোট ছোট প্রাণী ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশী। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ক্লডিও সিলেরো বলেন, ছোট প্রাণীর জন্য আমাজন এক নরকে পরিণত হয়েছে। আমাজনে যত আগুনের ঘটনা ঘটে তার শতকরা ৯৯% ই মনুষ্যসৃষ্ট। শুষ্ক মৌসুমে দাবানলের কিছু ঘটনা যে হয় না তা নয়। এর পরিমাণ খুব অল্প। এই অগ্নিকান্ডগুলি বৈশি^ক জলবায়ুর উপর দারুণ প্রভাব ফেলছে। বনঝাড় গুলো উজাড় হয়ে অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইড সৃষ্টি হয়ে আমাজন তথা বিশ্ব জীববৈচিত্রের মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। আমাজনে বসবাসকারী উপজাতিগুলো দারুণ হুমকীর মধ্যে আছে। পরিবেশবিদরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রশমনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা হলো আমাজনের জঙ্গল। বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিহত করার অন্যতম ভরসা আমাজন অরণ্য।
আর আমাজন যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তবে বিশ্বের জীববৈচিত্রের উপর বায়ুমন্ডলীয় কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব এবং বিশ্বের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। আমাজনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদ-নদীর মাধ্যমে দক্ষিণ আমেরিকা এবং তদসংলগ্ন এলাকায় প্রচুর জলীয় বাষ্প ছড়ানোর মাধ্যমে বড় একটি অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আমাজনের ক্ষতি যত বাড়বে এই বৃষ্টিপাতও ক্রমবর্ধমান হারে কমবে। চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এ অবস্থা যদি চলে থাকে তাহলে আমাজন এমন এক ‘টিপিং পয়েন্টে’ চলে যাবে, যেখানে আমাজনের অবস্থা আফ্রিকার শুষ্ক সাবানার ন্যায় এক বিরানভূমিতে পরিণত হবে। পরিবেশবিদেরা বর্তমানে এ ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। ক্ষমতায় আসার আগেই তিনি আন্তর্জাতিক হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করে আমাজন অঞ্চলকে চাষাবাদ, গবাদিপশু চারণ ক্ষেত্র এবং খনিজ উত্তোলনের জন্য ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং আস্কারা না পেলে এ অবস্থা কখনো হতো না। এই জাতীয় কার্যকলাপগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের জন্য নিষিদ্ধ হলেও আইনের ব্যবহারে শিথিলতার জন্য আমাজনে নির্বিচারে বন বিলীন হচ্ছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিবেশ সংরক্ষণ এজেন্সীর বাজেট কমিয়ে দিয়েছেন। বন ধ্বংসকারীদের জরিমানা হ্রাস করেছেন এবং একই সাথে ব্রাজিলের স্পেশ এজেন্সীর প্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় জঙ্গল বিনাশ অপকর্ম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের মানুষ যখন আমাজনের জন্য বিলাপ করছে তখন তিনি আমাজনে অল্পবিস্তর সৈন্য পাঠিয়েই ক্ষান্ত! বোলসোনারোর এখন বলছেন- “তাকে খামকা দোষারোপ করা হচ্ছে। শুষ্ক সময়ে আগুন জ্বালিয়ে চাষের জমি তৈরি করেন চাষীরা। সেটাই রেওয়াজ”।

মোট কথা, পৃথিবীর ‘সবুজ ফুসফুস’ অবিরাম জ্বললেও তথাকথিত মনুষ্যজাতির তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। তথাকথিত মোড়ল দেশগুলো একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে আছেন। বিগত শত শত বছর যে অরণ্য মানবকল্যাণ তথা প্রাণীকুল বাঁচানোর জন্য নিজকে সঁপে দিয়েছেন সে নিবিড় অরণ্যকে বাঁচানোর জন্য সকলে একযোগে এগিয়ে আসছে না। এমনকি জাতিসংঘকেও সেভাবে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে না। আমাজনের বাঁচার আর্থচিৎকারে সমগ্র পৃথিবী আজ বিভিষীকাময়। আমাজনের পোড়ার গন্ধ আজ এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবেশবাদীরা নিঃশব্দে অশ্রুবর্ষণ করছেন। পৃথিবীর বহু প্রাণীর বিলুপ্ত হয়েছে তাদের মাত্রাতিরিক্ত হঠকারীতার জন্য। মনুষ্য জাতিরও কী এ গ্রহে বেশীদিন থাকার আর ইচ্ছে নেই! ফুসফুস ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচতে পারে তেমনি আমাজন ছাড়াও পৃথিবী বাঁচবে না। আমাজনকে তিলে তিলে করে যেভাবে ধ্বংস করেছে তদ্রুপ পৃথিবীর আয়ুও একটু একটু করে কমছে। আমাজনকে বাঁচানো মানে বিশ্ব মানবতা বাঁচানোর শামিল। আসুন আমাজনকে রক্ষার জন্য আমরা দৃঢ় সংকল্প এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করি। না হয় সময় পরিক্রমায় এটি ধূসর মরুভূমি হয়ে সমগ্র দুনিয়াকে গ্রাস করবে। প্রকৃতি কখনো তার প্রতিদান দিতে ভুল করে না।

লেখক : কলামিস্ট, পরিবেশকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট