চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

শুভ মহালয়া

মনোজ কুমার দেব

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

শুভ মহালয়া। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক মহান তিথি। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে সাড়ম্বরে দেবী দুর্গার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ শুক্লপক্ষ মাতৃপক্ষ বা দেবীপক্ষ নামে পরিচিত। এ পক্ষের আগের কৃষ্ণপক্ষ হচ্ছে পিতৃপক্ষ বা অপরপক্ষ। কৃষ্ণপক্ষের সমাপ্তিতে মহালয়াতেই সূচিত হয় জ্যোতির্ময়ী মায়ের আগমনী বার্তা। তাই মহালয়া মানেই মৃন্ময়ী মায়ের চিন্ময়ী হয়ে উঠার শুভক্ষণ। মহালয়া মানেই শারদউৎসবের ক্ষণগণনা শুরু।

এ মহালয়া তিথিতে একাধিক ধর্মীয় কাজের সমন্বয় ঘটেছে বলে এ তিথি নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। মহালয়ার আগের পনের দিন পিতৃপক্ষ। এ পিতৃপক্ষ হচ্ছে পূর্ববর্তী প্রজন্মকে স্মরণ করার, পরম্পরাকে শ্রদ্ধা জানানোর এক প্রশস্ত পক্ষ। সনাতন ধর্ম অনুসারে পিতৃপক্ষে প্রয়াত পিতৃপুরুষের আত্মার মহাসমাবেশ হয়। প্রয়াত আত্মার মহাসমাবেশকেই বলা হয় ‘মহালয়’ আর মহালয় থেকে ‘মহালয়া’ শব্দের উৎপত্তি। মহাভারতেও দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর এ বিশেষ ক্ষণে পিতৃপুরুষের তর্পণের বিশেষ উল্লেখ আছে। রামায়ণেও উল্লেখিত আছে প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রীরামচন্দ্রের শুভ তর্পণের কাহিনী। পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির ধারক দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গা নয় দিনের যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত করেন আর ‘শুভ দশমী’ তিথি চিহ্নিত হয় বিজয়ের স্মারক ‘বিজয়ী দশমী’ হিসেবে। আবার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ‘আলয়’ শব্দের অর্থ গৃহ। আমাদের দেহটাই পবিত্র দেবগৃহ বা দেবালয়। মহালয়ার এ দিনে এ পবিত্র দেবালয়ে জ্যোতির্ময়ী দেবীকে অধিষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

শুভ মহালয়ার সাথে সম্পর্কিত দেবী মহামায়ার আবির্ভাব কাহিনী। দেবী মহামায়ার স্বরূপ বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হবে পৌরাণিক যুগে। দেবী মহামায়া পরমবিদ্যা আদ্যাশক্তি। এ বিশ্বব্রহ্মান্ড তাঁরই দিব্য রূপ। তিনি নিত্যা, সনাতনী ও পরমেশ্বরী। এ মহামায়ারই কাহিনী বিবৃত হয়েছে পুরাণে। আঠারটি পুরাণের এক পুরাণ হচ্ছে মার্কন্ডেয় পুরাণ। সে পুরাণের শ্রী শ্রী চন্ডী মহাগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে মহামায়া বন্দনার এক অপূর্ব কাহিনী।

চৈত্র বংশীয় বিখ্যাত রাজা সুরথ সসাগরা পৃথিবীর অধিশ্বর হয়েও রাজনৈতিক চক্রান্তে রাজ্যহারা হলেন। সহযোগী ও আত্মীয়স্বজন কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে তিনি বনবাসী হলেন। একদা উপস্থিত হলেন বেদজ্ঞ মেধস মুনির শান্ত তপোবনে। দৈবচক্রে সেখানে উপস্থিত হন দারাপুত্র পরিজন কর্তৃক বিতাড়িত আরো এক ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ- সমাধি বৈশ্য। রিক্ত, নিঃস্ব হয়েও নিকটজনের মায়া-মমতা তাঁরা ভুলতে পারছিলেন না। এ সমস্যা থেকে মুক্তি দেখালেন বেদজ্ঞ মহাঋষি মেধস। দুই তাপিত পুরুষের মর্মবেদনা উপলব্ধি করে তিনি জানালেন, শুধু মানুষ নয় ইতর প্রাণীকুলও মায়ামমতার বশীভুত হয় এক অলৌকিক শক্তির প্রভাবে। এ অলৌকিক শক্তিই হচ্ছে আদ্যাশক্তি মহামায়া। এ দেবীর প্রভাবেই মানুষ পরম সত্যকে বিস্মৃত হয়ে যায় এবং পৃথিবীর মায়াময় ও অনিত্য বস্তুর আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়। মুনিবর মেধসের পরামর্শে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য জগৎপালিনী মহামায়াকে তুষ্ট করে কৃপা লাভ করলেন। বসন্তকালে এ পূজা হয়েছিল বলে কালক্রমে এ পূজা ‘বাসন্তী পূজা’ নামে অভিহিত হয়।

ত্রেতাযুগে শ্রী রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের জন্য লংকা জয়ের মানসে অকালবোধনের মাধ্যমে দেবী মহামায়াকে জাগ্রত করেন।

‘বোধন’ শব্দের অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর শুক্লপক্ষের প্রতিপদে ঘট স্থাপন করে শারদীয় পূজার সূচনা করা হয়। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস দক্ষিণায়ন। এরপর উত্তরায়ন। দক্ষিণায়ন দেবতাদের বিশ্রামের কাল। তাই শরৎকালের পুজোয় বোধন প্রয়োজন। মহালয়ার পর দুর্গাপূজার বোধন সমাপ্তিতে সংকল্প করে দুর্গাপূজার রীতি সর্বজনবিদিত যা ‘প্রতিপদ কল্পরম্ভা’ নামে অভিহিত। তবে ষষ্ঠী থেকে পূজার প্রধান কার্যক্রম শুরু হওয়া বর্তমানে বহুল প্রচলিত যাকে বলা হয় ‘ষষ্ঠাদিকল্পরম্ভা’। সার্বজনীন দুর্গোৎসবের বিশাল কর্মযজ্ঞের ক্ষণগণনা শুরু হয় শুভ মহালয়া থেকে। ঐতিহ্য আর পরম্পরাকে স্মরণ করে শুরু হোক আত্মজাগরণ আর আত্মশুদ্ধির দিন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট