চীন সাগরের ছোট্ট একটি দ্বীপ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। তিন দিকে সমুদ্র ও একদিকে নদী দ্বারা মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। আয়তনে চট্টগ্রামের চাইতে ছোট দেশটি লোকসংখ্যা মাত্র ৫৬ লক্ষ। অথচ ছবির মতোই সাজানো চমৎকার সবুজ ও সুন্দর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশের মাত্র ছয় বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করলেও আইন শৃংখলার উন্নয়ন এবং সমুদ্রবন্দর ও পর্যটনকে পুঁজি করে ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে তারা। বর্তমানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর অন্যতম। একে বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ রাষ্ট্রও বলা হয়। দেশটি আমাদের দেশের কাছে হওয়ায় এমন উন্নত দেশ দেখার প্রচন্ড আকাক্সক্ষা ছিল। শুধু তাই নয় বিশ্বের ব্যয়বহুল দেশগুলোর মধ্যেও এটি অন্যতম হওয়ায় আর্থিক ব্যয়ের ব্যাপারটিও সাধ্যের প্রশ্নে ছিল। ১৮১৯ সালের পূর্বে ‘সিঙ্গাপুর’ দেশটির নাম ছিল তেমাসেক। পরে হয় ‘সিঙ্গাপুর’ যার অর্থ সংস্কৃতে ‘সিংহ শহর’ এবং তামিলে ‘সিংহের শহর’ বলা হয় ।
জানা যায়, সাং-নিলা উতামা নামীয় সূমাত্রার যুবরাজ ১৬ শতাব্দীতে ঝড়ের কবল থেকে বেঁচে আসে এবং সুমাত্রার যুবরাজ প্রথম দেশটিতে এসে একটি সিংহের দর্শন লাভ করে যাকে মালয়ে ‘সিংগা’ বলা হয়। তাঁর দেয়া ‘সিংগা’ নাম থেকে ‘সিঙ্গাপুর’।
জানা যায় সিঙ্গাপুরে তৃতীয় বৃহত্তম আদিবাসী হিসেবে তামিলদের বসবাস। সিঙ্গাপুর নামটি তামিল কিংবা সংস্কৃত থেকে আসে। লি কুয়ান ইউ কে সিঙ্গাপুরের জাতির জনক বলা হয়। কারণ তিনি এই ক্ষুদ্র দেশটিকে এশিয়ার অন্যতম ধনী এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশে পরিণত করেন। তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
২০১৫ সালের ২২ মার্চ ৯১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে সিঙ্গাপুর একটি অনুন্নত রাষ্ট্র ছিল, যার এউচ ছিল টঝ$৩২০ এর নীচে। কিন্তু আজ এটি পৃথিবীর অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র যার এউচ টঝ $৬০,০০০ যা’ সেন্ট্রাল ইন্টালিজেনস এর পরিসংখ্যান অনুসারে পৃথিবীতে ৬ষ্ঠতম। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদে দুর্বল এ দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এই উত্থান তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ববাণিজ্যিকীকরণ, উন্মুক্ত বিনিয়োগ, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রসার এবং যথাযথ সময়োপযোগী ব্যবস্থা ভৌগোলিক সমস্যার উত্তরণ ঘটিয়ে দেশটিকে বিশ্ববাণিজ্যের নেতৃত্বে সক্ষম করেছে। সিঙ্গাপুর ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে। ইউসুফ বিন ইসাক এর প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং অন্যতম প্রভাবশালী লিকুয়ান ইউ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
স্বাধীনতার পর পর ৪৩৩ বর্গমাইলের এই রাষ্ট্রটি নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। সে সময় প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ বেকার ছিল এবং জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করতো। আবার দুই প্রতিবেশী দেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অবন্ধুসুলভ আচরণে স্যান্ডউইচের মতো মাঝে পিষ্ট ছিল। তার না ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ না ছিল যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, অবকাঠামো এবং পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা।
দেশের উন্নয়নের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লি আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রার্থনা করেন কিন্তু তা শুধুই জলাঞ্জলি। কোন রকম সাড়া পাওয়া যায়নি। লি ও তার মন্ত্রীসভা জানতো অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য তাদেরকে গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্ববাণিজ্যের সাথে নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে হবে এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলোকে তাদের দেশে উৎপাদনে আগ্রহী করে তুলতে হবে। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য তাঁর সরকার দেশে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্নত ও নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে মনোযোগী হলো। ফলে একটি ক্ষমতাধর শাসক (ধঁঃড়পৎধঃ) সৃষ্টি করে চোরাচালানকারী এবং দুর্নীতিবাজদের মৃত্যুদন্ডের মতো কঠোর সাজা প্রদান করলো। এছাড়া অন্য যে কোন রাজনীতিক বা দল জাতীয়, রাজনৈতিক বা যে কোন জোট হুমকির কারণ হলে তাদেরকে কারাদন্ডের ব্যবস্থা করা হলো। এভাবে অত্যন্ত কড়াকড়ি শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে বিদেশীদের জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। (চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ, নারীউন্নয়নকর্মী।