চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

কারবালার নৃশংস হত্যাকান্ডে জড়িতদের দুনিয়া আখিরাতের শাস্তি প্রসঙ্গে

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

গত বিষ্যুদবার ইসলামের আলোকধারা কলামে আমরা শাহাদাতে কারবালার ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে এ নৃশংস হত্যাকান্ডের যারা কুশীলব ছিল তাদের নির্মম পরিণতি সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম। অন্যায় কখনো চিরস্থায়ী হয়না, কোন জালিমের জুলুমও চিরস্থায়ী হয়না। মিথ্যা একসময় পরাভূত হয়। আর জয় ঘটে সত্যের। এজন্য যদিওবা সময় ধৈর্য ও সবরের প্রয়োজন পড়ে। ইমাম হোসাইন (রা) ও তার পরিজন বন্ধুদের সাথে যারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে সেই প্রকারান্তরে নূর নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর আনীত আল্লাহতায়ালার দেওয়া পবিত্র আখিরী দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল তারা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নানা গজবে নিপতিত হয়। কেউ চিরদিনের জন্য অন্ধত্ব বরণ করে, কারও মাথার খুলিতে সাপের বসবাস হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা গত বিষ্যুদবার করা হয়। এখন প্রথমেই দেখবো এ হত্যাকান্ডে নেতৃত্বদানকারী আরেকজনের দুনিয়াবী শাস্তি।

বিবর্ণ চেহারা :ইতিহাসবিদ ও হাদীস গবেষক ইবন যাওজী বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি হযরত হুসাইনের (রা) মাথা মুবারক তার ঘোড়ার গলায় লটকিয়ে বাহাদুরী প্রদর্শন করেছিল পরে তাকে এ অবস্থায় দেখা গিয়েছিল যে, চেহারা আলকাতরার মত বিবর্ণ হয়ে গেছে। লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করে- তুমিতো সমগ্র আরবের মধ্যে সুশ্রী ছিলে। এখন তোমার চেহারা এমনটি হল কেন? সে বললো যেদিন আমি এই মস্তক ঘোড়ার গলায় লটকিয়েছিলাম সেদিন থেকে যখনি আমি একটু ঘুমিয়ে পড়ি তখনি দুজন লোক এসে আমার বাহু ধরে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডুলিতে নিয়ে যায় এবং তাতে আমাকে নিক্ষেপ করে। এভাবেই আমার মুখ অগ্নি ঝলসানো হয়ে যায়। এবং এই কষ্টেই সে এক পর্যায়ে মৃত্যুবরণ করে।

আগুনে পুড়ে মৃত্যু: ইবন যাওজী (রহ) সুদ্দী নামক একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন, তিনি এক ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। উপস্থিত মজলিসে কথা প্রসঙ্গে আলোচিত হয় যে, হুসাইন (রা) এর হত্যায় যারাই শরীক ছিল তাদের সবাইকে দুনিয়াতেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। সে লোকটি বললো, এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। আমি নিজেই উক্ত হত্যাকান্ডে শরীক ছিলাম। অথচ আমার কিছুই হয়নি। সে ব্যক্তি মজলিস শেষে তার ঘরে যায়। ঘরে পৌঁছেই সে চেরাগের ফিতা ঠিক করার সময় তার কাপড়ে আগুন লেগে যায় এবং সেখানেই জ্বলে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সুদ্দী (রহ.) বলেন- আমি নিজেই প্রত্যুষে যখন তাকে দেখি তখন সে একটি আস্ত কয়লায় পরিণত।
পিপাসায় ছটফট করতে করতে তীর নিক্ষেপকারীর মৃত্যু: যে ব্যক্তি হযরত হুসাইনকে (রা) তীর মেরেছিল এবং পানি পান করার সুযোগ দেয়নি আল্লাহতায়ালা তার উপর পিপাসার এমন শাস্তি প্রদান করেন যে, ঘটনার পর থেকে কোনভাবেই যেন তার পিপাসা দূর হচ্ছিল না। যত পানিই সে পান করছিল না কেন তবুও পিপাসায় সে ছটফট করত, অস্থির হয়ে পড়ত। এভাবে কিছুদিন চলতে থাকে। একসময় পানির পূর্ণতায় তার পেট ফেটে যায় এবং সে মৃত্যুবরণ করে।

ইয়াযীদের ধ্বংস: হুসাইন (রা) এর শাহাদাতের পর ইয়াযীদের ভাগ্যে একটি দিনও শান্তি জোটেনি। সমগ্র ইসলামী রাজ্যে শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের দাবী উঠে এবং বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। এ ঘটনার পর তার আয়ু দু’বছর আট মাস, অন্য বর্ণনাতে তিন বছর আট মাসের বেশী ছিলনা। দুনিয়াতেও আল্লাহ তায়ালা তাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেছেন বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহ, হানাহানি ও অস্থিরতার মাধ্যমে এবং এই অপমানজনক অবস্থাতেই সে ধ্বংস হয়ে যায়।
কুফাতে মুখতারের আধিপত্য: হুসাইন (রা.) এর হত্যাকারীদের উপর এমনিতেই বিভিন্ন রকমের যমীনী ও আসমানী বালা-মুছীবতের এক সিলসিলা ছিল। এছাড়াও শাহাদাতের ঘটনার মাত্র পাঁচ বছর পর হিজরী ৬৬ সালে মুখতার যখন হুসাইন (রা) এর হত্যাকারীদের কেছাছ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, সর্বসাধারণ তাকে সমর্থন প্রদান করে এবং কিছু দিনের মধ্যেই তিনি বিপুল শক্তি অর্জন করে কুফা ও ইরাকের উপর তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেন। দেশের ক্ষমতা লাভের পর তিনি সাধারণ ঘোষণা প্রদান করেন যে, হুসাইন (রা.) এর হত্যাকারীদের ছাড়া বাকী সবাইকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হল। এরপর তিনি হুসাইন (রা) এর হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করেন এবং এক একজনকে গ্রেফতার করে হত্যা করেন। একদিনেই ২৪৮ জনকে এ অপরাধে হত্যা করা হয় যে, তারা হুসাইনের হত্যায় শরীক ছিল। এরপর বিশেষ ব্যক্তিদের অনুসন্ধান ও গ্রেফতারের কাজ শুরু হয়। যেমন: আমর ইবন হাজ্জাজ যুবাইদী, আব্দুললাহ ইবন উসাইদ জুহানী, মালেক ইবন বশীর বদী, হামল ইবন মালিক, ওসমান ইবন খালেদ, বশীর ইবন শমীত প্রমূখ। এরা কেউ এ উত্থিত শক্তির দন্ড ও শাস্তি থেকে রেহাই পায়নি।
আমর ইবন সাদ নামক যে ব্যক্তিটি হযরত হুসাইন (রা) এর মুকাবিলায় সৈন্যদের পরিচালনা করেছিল তাকে হত্যা করে তার মাথা মুখতারের সামনে উপস্থিত করা হয়। এদিকে মুখতার পূর্বেই তার ছেলে কারবালা হত্যাকান্ডের আরেক অপরাধী হাফ্সকে তার দরবারে বসিয়ে রেখেছিলেন। যখন আমর ইবন সাদের মাথা দরবারে উপস্থিত করা হয় তখন মুখতার হাফসের উদ্দেশ্যে বলেন, তুমি কি জান এটা কার মাথা?’’ সে বললো হ্যাঁ জানি। এ আমার পিতার খন্ডিত মস্তক।’ সে বুঝতে পারল এ পরিণতি শীঘ্রই তারও হবে। এজন্য সে বললো, আমিও আমার অপরাধের দায় স্বীকার করি, আমারও আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’ এক পর্যায়ে তাকেও মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল। এরপর শাসক মুখতার বললেন, আমর ইবনে সাদকে হত্যা করা হল হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর নৃশংস হত্যার বদলায়। আর হাফ্সকে হত্যা করা হলো আহলে বাইতের আরেক সদস্য হযরত আলী ইবন হুসাইনের হত্যার বিনিময়ে। আর সত্যিকারভাবে বলতে গেলে এরপরও বদলা বরাবর হয়নি। যদি আমি কুফাবাসীদের তিন চতুর্থাংশকেই হুসাইনের বিনিময়ে কতল করে দেই তবুও হযরত হুসাইনের একটি আঙ্গুলের বরাবরও বদলা হতে পারেনা। হাকীম ইবনে তোফায়েল, যে ব্যক্তিটি হুসাইন (রা) কে তীর নিক্ষেপ করেছিল, তার শরীরকে তীরের আঘাতে আঘাতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয় এবং এভাবে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ‘কাযালিকাল আ’যাব, ওয়াল আ’যাবুল আখিরাতি আকবার, লাউকানূ ইয়ালামু’ন।’- এটিই হল দুনিয়ার মধ্যে এক ধরনের বড় আযাব, শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত। আর আখিরাতের আযাব তো আরও ভয়াবহ। যদি তারা তা জানত। (আল কুরআন)।

আমরা সকলে জানি, মুহরমের আশুরা বিশ্ব ইতিহাসে অসংখ্য ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী। ঠিক একইভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখবো, ৬১ হিজরীতে সংঘটিত মর্মন্তুদ কারবালার ঘটনাও পরবর্তী ইসলামী দুনিয়ার দেদার উত্থান পতনের দৃশ্য ও বিপ্লব প্রতিবিপ্লবের উৎসমূল। পরবর্তী মুসলিম ইতিহাস ও শাসন প্রণালীতে এর প্রভাব রয়েছে সুদূরপ্রসারী। কারণ, যুগে যুগে রয়েছে স্বার্থান্ধ মিথ্যুক ও প্রতারক শ্রেণীর পদচারণা, মুখোশধারীদের দৌরাত্ম্য আর এদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য, সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য জিন্দাদিল মু’মিন মানুষদের আবির্ভাব ও সাহসী সংগ্রাম। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যুগসন্ধিক্ষণে এ সংস্কার ও সংগ্রামে অনুপ্রেরণা হিসেবে মূর্ত হয়ে উঠেছে বারেবারে হযরত ইমাম হুসাইনের (রাদি.) আদর্শ ও আহলে বাইতের শাহাদাত।
সমাজে যুদ্ধ জিহাদ লেগেই আছে। আল কুরআনের ভাষায় এক শ্রেণীর লোক আছে যারা যুদ্ধ করে তাগুতের হয়ে সত্যের বিপক্ষে। আর এক শ্রেণীর মানুষ আছে বা ঈমানদার রয়েছে তারা জিহাদ করে ফী সাবীলিল্লাহ আল্লাহর পথে। সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য।

আবদুল মালেক ইবন উমায়ের লাইছী’র বর্ণনা, তিনি বলেন যে, আমি কুফার রাজপ্রাসাদে হযরত হুসাইন (রা) এর মস্তক আবদুল্লাহ ইবন যিয়াদের সামনে একটি থালার উপর রক্ষিত দেখেছিলাম। আবার এই একই প্রাসাদে দেখেছি আব্দুল্লাহ ইবন যিয়াদের খন্ডিত মস্তক মুখতারের সামনে। আবার সেই প্রাসাদেই দেখেছি মুছআব ইবন যুবাইরের সামনে মুখতারের দ্বিখন্ডিত মস্তক। তারপর ঠিক একই স্থানে দেখেছি মুছআ’ব ইবন যুবাইর এর ছিন্ন মস্তক আবদুল মালেকের সামনে। কয় বছর পর পর এভাবে রক্তঝরা বিপ্লবের পর এক একটি নৃশংস প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে মুসলমানের হাতে মুসলমান। আমি এ বেদনাকাতর ধারাবাহিক ঘটনা খলিফা আবদুল মালেকের সামনে আলোচনা করি। তখন তিনি অনেক ভেবে চিন্তে উদ্বিগ্ন হয়ে এ প্রাসাদকে অভিশপ্ত মনে করে এ প্রাসাদ ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে যান। এজন্যই ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন কারবালা ছিল আজকের যুদ্ধের তুলনায় একটি অসম ও ছোট্ট যুদ্ধ। কিন্তু নৃশংসতা ও ধারাবাহিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের এক সুদূরপ্রসারী ঘটনা।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট