চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ

ফরিদুল আলম

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে জাতি সংঘ সাধারণ পরিষদের অধি বেশন শুরু হয়েছে। প্রথা অনুযায়ী প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার থেকে এই অধিবেশন শুরু হলেও প্রথম ৭ দিন এর দাপ্তরিক পুনর্বিন্যাসে অতিবাহিত হয়। এই সময়ের মধ্যে ২১ জন সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ইতোমধ্যে নাইজেরিয়ার তিজ্জানি মোহাম্মদ বান্ডে চলতি অধিবেশনের জন্য সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। আনুষ্ঠানিক বিতর্ক শুরু হবে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে এবং চলবে পরবর্তী দুই সপ্তাহ। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এবং তাদের অনুপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। প্রতি বছর এই সময়টিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বনেতাদের মিলনমেলা বসে, যেখানে শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান উপস্থিত হন। প্রাসঙ্গিকভাবেই মনে হতে পারে বৈশ্বিক অনেক সমস্যার একটা সমাধান পাওয়ার ক্ষেত্র হিসেবে বিশ্বনেতারা জাতিসংঘের শরণাপন্ন হন। আফসোসের বিষয় হচ্ছে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যে সকল বিষয় উত্থাপিত হয় এবং পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়ে থাকে, সদস্যরাষ্ট্রগুলোর উপর এর কার্যতঃ কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং সেই সাথে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সাধারণ পরিষদের কোন ক্ষমতা না থাকায় এটিকে নিছক একটি মিলনমেলা ছাড়া কিছুই বলার সুযোগ থাকেনা। তবে সাধারণতঃ প্রতি বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের নিয়মিত বিতর্কের ফাঁকে বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর কিছু উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এবারও বেশ কয়েকটি সেধরণের বৈঠক এজেন্ডাভুক্ত রয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, সাধারণ পরিষদের এই অধিবেশনকে সামনে রেখে মূলতঃ নিজ নিজ দেশের সরকারপ্রধানরা একদিকে যেমন তাদের নির্ধারিত সময় বক্তব্য উপস্থাপন করেন, একইসাথে অনেকগুলো প্ল্যানারি সেশনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ অনেকক্ষেত্রে তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব পেতে সাহায্য করে থাকে। বিভিন্ন বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ফোরাম থেকে সরকারপ্রধানদের সম্মাননা দেয়া হয়ে থাকে। এবার এমন দুটি সম্মাননা পাচ্ছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই) তাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করবে। আর জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ ২৬ সেপ্টেম্বর ‘অ্যান ইভনিং টু অনার হার এক্সিলেন্সি প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করবেন।

১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হয় এই বিশ্বফোরামে। এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্যপদ অর্জন করে। সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনেক দিক দিয়েই আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি জাতিসংঘে বাংলায় তাঁর বক্তব্য প্রদান করেন; দ্বিতীয়ত, নব্য স্বাধীন দেশের প্রথম অংশগ্রহণ সকল সদস্যদের মাঝেই এক ধরণের আগ্রহের সৃষ্টি করে, এক্ষেত্রেও তাই করেছিল এবং ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু এরই মধ্যে বিশ্বনেতাদের কাতারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর ঐ ভাষণ কেবলমাত্র সরকারপ্রধান হিসেবে একটি প্রথাগত ভাষণ ছিলনা, বরং তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনারও বিষদ চিত্রায়িত হয়েছে। জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের এই দীর্ঘ পথচলায় যার ছায়া আমরা প্রতিনিয়তই অনুভব করি।

যদিও জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে, কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকেই। বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর পর যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী নাগরিক ভারতে গিয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে, সেই অবস্থায় ভারতীয় সরকার ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর আবেদন জানায়। ভারতের আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কূর্ট অয়েল্ডহেইম জাতিসংঘ মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনারের (ইউ এন এইচ সি আর) অধীনে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউ এফ পি) এবং জাতিসংঘ শিশু সংস্থা (ইউনিসেফ) এর সহায়তায় শরণার্থীদের প্রাথমিক সহায়তা কর্মসূচী শুরু করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ঘটে যাওয়া তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঘটনাপ্রবাহের প্রতি জাতিসংঘ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনাক্রমে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের জন্য জাতিসংঘের কর্মীবাহিনী কর্তৃক মানবিক সহায়তা প্রদান এবং জাতিসংঘের কর্মীবাহিনীর চলাফেরার বিষয়টি নির্বিঘœ করতে পাকিস্তান সরকারের সমর্থন আদায় করা হয়। এ সময় পূর্বপাকিস্তানের বিপন্ন মানবতার জন্য ত্রাণ সহায়তা প্রদানের জন্য বাঘা এ ই তাওইল কে মহাসচিবের প্রতিনিধি নিযুক্ত করে ইউনেপ্রো নামক বিশেষ কমিশন গঠন করা হয়।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মহাসচিবের তৎপরতায় জাতিসংঘ শিশু তহবিল, জাতিসংঘ খাদ্য তহবিল, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বয়ে একটি সমন্বয় পরিষদ গঠন করা হয় এই অঞ্চলের মানুষের সাহায্যের জন্য। সেই সাথে মহাসচিব সার্বিক বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরোটা সময় জাতিসংঘ এভাবে আমাদের পাশে থেকে মুক্তিকামী মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ সময় বিশেষ করে আমাদের বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। নিরাপত্তা পরিষদে আনীত যুদ্ধ বিরতিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রদানই আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।

জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের সম্পর্ককে যদি একনজরে আমরা ফিরে দেখার চেষ্টা করি তবে এটুকুই বলতে হয় বাংলাদেশ সবসময়ই জাতিসংঘের মূলনীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কাজ করে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে যখন অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত পাশ কাটিয়ে কিংবা জাতিসংঘের সনদের অবমাননা হয় এমন অনেক কাজই করা হচ্ছে এবং এর অজুহাত হিসেবে তথাকথিত বিশ্বশান্তি এবং নিরাপত্তার দোহাই দেয়া হচ্ছে, তখন বর্তমান সময়ে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল বিশ্বের অগাধ সমর্থন নিয়ে শত প্রতিকূলতার মাঝেও তার কার্যক্রম চালিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের নীতিমালার অধীনে তার কাজ করে যেতে সর্বদা সচেষ্ট। আর এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো প্রামাণ্য তা হল, প্রথমত, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ নিয়মিত জাতিসংঘে তাদের অনেক বাৎসরিক চাঁদা পরিশোধ না করলেও এবং ক্ষেত্রবিশেষে দীর্ঘদিন ধরে তা বকেয়া রাখলেও বাংলাদেশ নিয়মিত চাঁদা প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা জাতিসংঘে আমাদের অঙ্গীকারকে আরও প্রতিষ্ঠিত করে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সবচাইতে উজ্জ্বল উপস্থিতির জায়গাটি হচ্ছে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে। অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সর্বাধিক সৈন্য প্রেরণকারী দেশ। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী টঘওওগঙএ এবং টঘওঞঅএ নামক কর্মসূচীতে ইরাক এবং নামিবিয়াতে অংশগ্রহণ করে। এর পর থেকে বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বেড়েই চলছে। প্রথমে সেনাবাহিনী এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীও এতে সংযুক্ত হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ১৮১ জন শান্তিরক্ষী ৪০টি দেশে ৫৪টি মিশনে অংশগ্রহণ করেছে।

বক্তব্যের শুরুতেই উল্লেখ করেছি বৈশ্বিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেমন ইরাক, ইরান, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, আফগানিস্তান, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ইত্যাদি সমাধানের জন্য সাধারণ পরিষদকে নিয়ামক শক্তি ভাবার কোন উপায় নেই। তবে এখানে একইসাথে এটাও উল্লেখ করা সঙ্গত যে, সমাবেত বিশ্বনেতাদের বেশিরভাগই যেহেতু শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত শান্তির বাণী শান্তি বিনাশকারীদের জন্য এক অর্থবহ বার্তা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আর তাই বলা চলে এই শান্তির তাগিদেই এমন এক সম্মিলনের অংশ হওয়া। জাতিসংঘের গত ৭৪ বছরের যত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্জন সেগুলোকে যদি এক করা হয় তাহলে এত ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেও এর টিকে থাকার যথার্থতা অনুধাবন করা সম্ভব হবে। তাই কেবল বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশের মত অনেক দেশ, তারা ক্ষুদ্র হলেও, নানান বিবেচনায় দুর্বল হলেও জাতিসংঘের মূলনীতিকে ধারণ করে বিশ্ব শান্তির ঝান্ডা উড়িয়ে চলছে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট