চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

শিশু-কিশোরদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে হবে

শাহীন চৌধুরী ডলি

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে বলছেন, ইন্টারনেটের অতিরিক্ত আসক্তিতে একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হয় তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক মেধা বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাদের আচরণে নানা সমস্যা হানা দেয়। ইন্টারনেটের প্রতি শিশু-কিশোরদের মারাত্মক আসক্তি দেখে মনোবিজ্ঞানীরা একে “ডিজিটাল কোকেন” নামেও আখ্যায়িত করেছেন। কোকেন যেমন মানুষের স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেয়, ফেসবুক বা ভিডিও গেইম তেমনি শিশু-কিশোরদের স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দেয়। টিভি, স্মার্টফোন, ট্যাব, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ভার্চুয়াল গেইমে আসক্তি শিশু-কিশোরদের বিরাট ক্ষতি সাধন করে।

ইন্টারনেটের প্রতি শিশু-কিশোরদের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বহু আগেই মানসিক রোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ২০১৬ সালে ইউনিসেফ রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। কি ভয়ানক তথ্য!
বিষয়টি নজরে নিয়ে ইংল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ বিশেষ ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত মনিটরিং শুরু করেছে। জাপানে যদি কেউ একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি গেইম খেলে তাকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের আইন অনুযায়ী ১৬ বছরের কমবয়সী শিশুরা মধ্যরাত থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত অনলাইন গেইম খেলতে পারে না। চীনের ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান টেনটেন্ট শিশুদের গেইম খেলার সময় বেঁধে দিয়েছে। বাংলাদেশে এইক্ষেত্রে সচেতনতা এখনো তেমনভাবে চোখে পড়ার মতন নয়।

এক গবেষণার ফলাফল বলছে, যে সকল শিশু-কিশোররা দৈনিক ৫ ঘণ্টার বেশি ট্যাবলেট, স্মার্টফোন, টেলিভিশনের মতন ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে সময় অতিবাহিত করে তাদের স্থুলকায় বা মোটা হওয়ার সম্ভাবনা যে শিশু-কিশোররা এগুলো ব্যবহার করে না, তাদের তুলনায় ৪৩% বেশি। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক তথ্য। শিশু-কিশোরদের টেলিভিশন এবং অন্যান্য স্ক্রিন ডিভাইস ব্যবহারের সময়সীমা সীমিতকরণ অত্যন্ত জরুরি।

কমবয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্ক্রিন অ্যাডিকশন দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তাদের মধ্যে বাইরে বেড়াতে যাওয়া, আউটডোর খেলাধুলা করা, গল্প করা ইত্যাদি, মুখোমুখি ইন্টার অ্যাকশন মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। বিশ্বখ্যাত ডিজিটাল প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, অ্যাপলের বর্তমান চিফ অপারেটিং অফিসার টিম কুক, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, ফেসবুকের প্রথম চেয়ারম্যান সিয়ান পারকার, ফেসবুকের সাবেক এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট আথেনা শাভারিয়াসহ সকলেই শিশু-কিশোরদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ভয়াবহতা নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত। ডিজিটাল প্রযুক্তিবিদ, কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও উদ্যেক্তাদের একটা বিরাট অংশ নিজেদের তৈরি করা ডিজিটাল যন্ত্র ও অ্যাপ থেকে নিজেদের সন্তানদের দূরে রাখার চেষ্টা করছেন।

সিলিকন ভ্যালির ৯০০-র বেশি পরিবার শিশু-কিশোর দের স্ক্রিন আসক্তি কমাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যে যেসব শিশুরা আসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের স্ক্রিন আসক্তি থেকে বের করে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশেও আমরা আমাদের শিশু-কিশোরদের নিয়ে কঠিন সময় পার করছি। আমাদের উচিৎ শিশুদের মস্কিষ্কের সচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন হওয়া। একদিন দু’দিনেই সুফল পাওয়া সম্ভব হবে না। সুফল পেতে হলে ধীরে ধীরে লক্ষ্যে আগাতে হবে। সন্তানদের বকাঝকা করে কোন কাজ হবে না। তাদের ডিজিটাল স্ক্রিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে হবে। অতিরিক্ত সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ভার্চুয়াল গেইম বা ইউটিউবে না কাটানোর জন্য পুরষ্কৃত করলে তাদের ভালো লাগতে পারে। সন্তানের সাথে সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে। তাদের নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে হবে। বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাসায় নিয়ে তাদের শিশুদের সাথে মেলামেশার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তাদের নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে।

শিশুদের বারবার উপদেশ দিলে তারা বিরক্ত হয়। তাদের বিরক্ত না করে নিজেকে এমনভাবে সন্তানের সামনে উপস্থাপন করতে হবে যাতে শিশু আপনার সুন্দর কাজে অনুপ্রেরণা পায়। নিজেকে ভার্চুয়াল লাইফে জড়িয়ে রেখে শিশুকে নিষেধ করলে তা শিশুর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে, এটা মনে রাখতে হবে। নিজে ধর্ম পালন করে শিশুকে ধর্ম পালনে দীক্ষা দিতে হবে। সামাজিক ভালো এবং সেবামূলক কাজগুলোতে নিজের সাথে সন্তানকে সংযুক্ত করলে সন্তানও ভালো কাজ করতে উৎসাহিত হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতে হবে। একবার বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দিতে পারলে তারা ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং এর ডিভাইসগুলোর অতি ব্যবহার থেকে সরে আসবে। তাদের মাঝে বই পড়ার আনন্দ তৈরি হবে বয়স উপযোগী এমন সব বই পড়তে দিতে হবে। বই পড়া শেষ হলে গল্পচ্ছলে কি পড়লো তা আগ্রহ নিয়ে শুনতে হবে। বই পড়ার জন্য ছোটখাট পুরস্কার পেলে নতুন বই পড়ায় আরো বেশি উৎসাহী হবে।

আমরা শিশুদের ঘরবন্দী করে ফেলেছি। ইট-পাথরের চারদেয়ালে তাদের আবদ্ধ জীবন থেকে বের করে আনতে হলে খেলার মাঠের কোন বিকল্প নেই।

শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা সময়ের অন্যতম দাবী। শিশুরা যদি খোলা আকাশের নিচে খোলা মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, কাবাডি, ভলিবল, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধাসহ আরো অনেক খেলার সুযোগ পায় তাহলে তাদের শরীর মন চাঙ্গা হবে এবং তারা নিজ থেকেই ধীরে ধীরে প্রযুক্তির অতিরিক্ত আসক্তি থেকে সরে আসবে।
পরিবার এবং দেশের সরকারের সম্মিলিত প্রয়াসে ইন্টারনেটের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষা করা অন্যতম প্রয়োজনীয় কর্তব্য। আমাদের নিজেদের শিশুদের অথর্ব করে গড়ে তুললে জাতি একটি প্রতিবন্ধী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে, যা পরিবার তথা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে আসবে। শিশুদের অবশ্যই প্রযুক্তির সাথে পরিচয় থাকতে হবে, এর ব্যবহার জানতে হবে তবে তা যেন তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় হুমকি হয়ে দেখা না দেয়।

আসুন, আমরা সকলে মিলে আমাদের শিশু-কিশোরদের সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার দিকে সচেতন হয়ে খেয়াল রাখি। মনে রাখতে হবে, আজকের শিশু-কিশোররাই জাতির আগামী ভবিষ্যৎ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট