ফুসফুসের কাজ : ফুসফুস আমাদের শরীরের একটি বড় অঙ্গ। যেই অঙ্গটি দিনে ২৪ ঘণ্টা সপ্তাহে সাতদিন ও বছরে ৩৬৫/৬৬ দিন অনবরত কাজ করে। ফুসফুসের মাধ্যমে বাতাস থেকে অক্সিজেন আমাদের শরীরে ঢুকে এবং কার্বনডাই-অক্সাইড শরীর থেকে বের হয়ে যায়। আমাদের শরীরকে কার্যক্ষম রাখতে প্রতি মিনিটে ১২ থেকে ১৫ বার এবং প্রতিদিনে ১৭,০০০ (সতের হাজার) এবং বছরে ৬০ (ষাট) লক্ষ অথবা ছয় মিলিয়ন শ্বাসপ্রশ্বাস আমরা নিয়ে থাকি। আমাদের ফুসফুস সুস্থ্য থাকলে এই শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাপারটা খুব স্মুথলি হয় যে, আমরা বুঝতেই পারি না। কিন্তু যখনই একজন মানুষ বুঝতে পারে যে তার শ্বাসপ্রশ্বাস করাটা অবচেতন মনে হচ্ছে না তখনই বুঝতে হবে এই ফুসফুস নামক অঙ্গটির কস্ট হচ্ছে অক্সিজেন গ্রহণ করে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করতে।
আগেই বলেছি ফুসফুস আমাদের শরীরের একটি বড় অঙ্গ। দুইটা ফুসফুস এর সারফেস এরিয়া একটি লন টেনিস মাঠের সমান এবং শ্বাসতন্ত্রের মোট দৈর্ঘ্য ১৫০০ মাইল। এই দূরত্ব প্রায় বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে ভারতের চেন্নাই এর দূরত্বের সমান। আমরা শ্বাস নেওয়ার পর বাতাস নাক, মুখ, শ্বাসনালী ও মেইন ব্রংকিয়াল টিউব দিয়ে ফুসফুসে ঢুকে। তারপর বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার ভেতর দিয়ে বাতাস ফুসফুস এর ছোট ছোট বায়ুথলী এলভিওলাইতে পৌঁছে। এখানেই বাতাসের অক্সিজেন রক্তে ঢুকে এবং রক্ত থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রশ্বাসের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
আমাদের দুইটি ফুসফুস আছে। ডানদিকের ফুসফুস তিন ভাগে বিভক্ত এবং বামদিকেরটি দুইভাগে বিভক্ত। হার্ট এর জন্য জায়গা করে দিতে হয় বলে বামদিকের ফুসফুসটি একটু ছোট হয়। শ্বাস নিলে ফুসফুস বেলুনের মত ফুলে যায়। দুইটি ফুসফুস ৬ লিটারের সমপরিমাণ বাতাস ধারণ করতে পারে। আমরা প্রতিদিন ২০০০ গ্যালন বাতাস শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকি। এই বাতাসের পরিমাণ একটি নরমাল সুইমিং পুলের পানির সমান। ফুসফুস প্রতিনিয়ত শ্বাস এর সাথে বাইরের বাতাস শরীরের ভেতর নেওয়ার সময় বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধুলাবালি ও জীবাণুও ঢুকে যায়। ফুসফুসের শাখাপ্রশাখার দেয়ালে অনবরত সিলিয়ার (সুক্ষ্ম চুলের মতো) চলাচলে মিউকাসের মাধ্যমে এই ধুলাবালি ও জীবাণু আমাদের গলার কাছে আসে এবং হাঁচি ও কাশির সাথে বের হয়ে যায়।
ফুসফুসের ক্যানসার কিভাবে হয়?
কিন্তু ফুসফুস যখন বিষাক্ত বাতাসের (বিশেষ করে সিগারেট এর ধোঁয়া) সংস্পর্শে আসে তখন ধীরে ধীরে কোষের মিউটেশন শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে ক্যানসারে রূপান্তরিত হয়। আমরা জানি সিগারেট বানানোর সময় তামাকপাতার সাথে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন- এ্যামোনিয়া (টয়লেট পরিস্কারের জন্য ব্যবহৃত হয়) মেশানো হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সিগারেটে ৪০০০ রকমের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে। নিয়মিত ধুমপান করলে ফুসফুসে এই বিষাক্ত পদার্থের কারণে ক্যানসার হয়ে থাকে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়াও যানবাহন, ইটের ভাটা ও কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ও ফুসফুসের ক্যানসার এর কারণ।
বাংলাদেশে প্রতিবছর কতজন এর ফুসফুসের ক্যানসার হয় তার সঠিক সংখ্যা আমাদের জানা নাই। কারণ আমাদের কোন ন্যাশনাল ক্যানসার রেজিস্ট্রি এখনো করা হয় নাই। তবে গ্লোবোকোনের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের পুরুষদের ভেতর ফুসফুসের ক্যানসার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং প্রতিবছর কমবেশী ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে সিগারেটের ব্যবসা : ইউরোমনিটর রিসার্চ এর মতে ২০২২ সালে বাংলাদেশে সিগারেট ব্যবসার মার্কেট ৪২০ বিলিয়ন টাকা। পদ্মাব্রিজ বানাতে খরচ হয়েছে ৩২৬ বিলিয়ন টাকার মত। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোবাংলাদেশ (ইঅঞই) টোব্যাকো মার্কেটের প্রায় ৮৫ ভাগ ডমিনেট করে থাকে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহত বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছিল জাপান টোব্যাকোর আকিজ গ্রুপের সিগারেট কোম্পানী ক্রয়ের মাধ্যমে। লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১.৪৭ বিলিয়ন ডলার। ইদানীং টিভি বা রেডিওতে সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। কিন্তু সিগারেট ব্যবসার কমতি নাই। অনেক টিভি নাটকে নায়ককে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে অভিনয় করতে দেখা যায়। সেই দৃশ্য অনেক সময় দর্শকদের সিগারেট সেবন করতে উদ্বুদ্ধ করে। সিগারেটের বিজ্ঞাপনের সরাসরি প্রচার না থাকলেও ফুসফুসের ক্যানসার ও অন্যান শ্বাসজনিত অসুখ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই বিশেষ করে কানাডায় সিগারেটের ব্যবসায় কড়াকড়ি আরোপ করার ফলে ফুসফুসের ক্যানসারের হার কমে এসেছে। ১৯৬৫ সালে ৬১% কানাডিয়ান সিগারেট সেবন করতো। কড়াকড়ির আইন এবং নাগরিক সচেতনতার ফলে ২০২১ সালে সিগারেট সেবনকারীর হার এখন ১২%। যার ফলে ফুসফুসের ক্যানসারের হার ২০২৩ সালে ৫৬% কমে এসেছে ১৯৮৮ সালের তুলনায়। সিগারেট সেবনের জন্য ৭২% ফুসফুসের ক্যানসার হয়ে থাকে বাকী কারণগুলো হলো রেডন গ্যাস, এস্বেসটস ও বাতাসের পলিউশন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমার ধারণা সিগারেট সেবন ও বাতাসের পলিউশন ফুসফুস ক্যানসারের কারণ।
ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধে জনগণের ভূমিকা : যদিও বাংলাদেশ সরকার ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করেছে। যেখানে বলা আছে, ৫। (১) কোন ব্যক্তি- (ক) প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোনভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না। ইদানীং টিভি বা রেডিওতে সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। কিন্তু সিগারেট ব্যবসার কমতি নাই। সেই সাথে ফুসফুসের ক্যানসার ও অন্য অসুখও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
যারা নিয়মিত ধূমপান করেন তাদের উচিত অতি সত্ত্বর ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ধূমপান থেকে বিরত হওয়া। ধূমপানের ফলে মানুষের ব্রেইনে নিকোটিন ঢুকে যায় এবং কিছু ক্যামিকেল রিলিজ করে, যার ফলে একধরনের সুখানুভুতির সৃস্টি করে। এই সুখ পাওয়ার জন্য সিগারেটের প্রতি নেশা সৃস্টি হয়। সেই জন্য সিগারেট ছাড়া খুব কষ্টকর হয়। ডাক্তারের কাছে গেলে নিকোটিন প্যাচ অথবা গাম এর সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে সিগারেটের নেশা থেকে মুক্তিপাওয়া সম্ভব। যারা গত ১০ থেকে ১৫ বছর নিয়মিত কমবেশী দিনে ১ প্যাকেট সিগারেট সেবন করেছেন তাদের উচিত এই মুহূর্তে ফুসফুসের একটি লো ডোজ সিটি স্ক্যান করে দেখা এবং সিগারেট সেবন বন্ধ করা।
আমরা নিজেরা সম্মিলিতভাবে কিছু উদোগ নিলে আস্তে আস্তে সিগারেটের সেবন কমে আসবে। ১। নিজের বাসা এবং অফিসে কখনো সিগারেট সেবন করবেন না। ২। আপনার বিজনেসে অধূমপায়ী কর্মচারী নিয়োগের বিধান রাখতে পারেন। ৩। ড্রাইভার, দারোয়ান ও বাসায় সাহায্যকারী হিসাবে অধূমপায়ীদের অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। ৪। আপনার গলির মোড়ের দোকানদারকে মোটিভেশন করুন সিগারেট বিক্রি না করার জন্য। ৫। মসজিদের ইমাম সাহেবকে সাজেস্ট করা অন্তত প্রতিমাসে খুতবায় সিগারেট পানের খারাপ দিকগুলো যেন মুসল্লীদেরকে বলেন। ৬। নিজেকে একজন ধুমপান নিবারনকারী এডভোকেট হিসাবে গড়ে তুলুন, যাতে করে এর কুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে রিকশাচালক, সিএনজি চালক, দিনমজুর, হকার মোটকথা যত মানুষের সংস্পর্শে আসবেন সবাইকে সিগারেট পানের কুফল পৌঁছাতে পারেন। ৭। আপনার পরিচিত রাজনৈতিক নেতা অথবা নেত্রীকে বলুন প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে ফুসফুসের লো ডোজ সিটি স্ক্যান এর ব্যবস্থা করতে। ৮। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রায় সিগারেটের প্যাকেটে ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার সতর্কবানী লেখা নাই। ‘সিগারেট ফুসফুসের ক্যানসার সৃষ্টি করে’- এই কথাটা প্রতিটি ব্রান্ডের সিগারেটের প্যাকেটে লেখা বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার।
বর্তমানে বাংলাদেশে এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে কমে ৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ব্যয় করতে হয়। দেশে এক কেজি চালের দাম ৫০- ৮০ টাকার ভেতর। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রতিদিন এই বিষ না কিনার শপথ করি এবং নিজেকে ফুসফুসের ক্যানসার থেকে মুক্ত রাখি।
পূর্বকোণ/আরডি