বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক কোটি মানুষই এ রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে এক লাখ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশে^ ৫৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তবে সচেতনতার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল জীবনযাপনেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ডায়াবেটিসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ৩৫-৫০ বছর বয়সীরা। দেশের কর্মক্ষম ও পরিণত জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু তারাই নয়। এতে আক্রান্ত হচ্ছে
শিশুরাও। এর জন্য খাদ্যাভ্যাসই এর জন্য দায়ী। তাই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যে (ব্যালেন্সড ডায়েট) অভ্যস্ত হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তবেই ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিস নির্মূল করা সম্ভব বলেও মত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি। তবে শঙ্কার বিষয় হলো প্রতি দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন এখনও জানেন না তারা ডায়াবেটিস আক্রান্ত কি না। তবে দুর্ভাগ্য যারা জানেন যে তারা এ রোগে আক্রান্ত তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশকে রোগের সঠিক জ্ঞান ও সুচিকিৎসার আওতায় আনা এখনো সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র অজ্ঞতার কারণেই এ রোগে প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মৃত্যু বরণ করছেন ।
এমন অবস্থার মধ্যেই বিশ্বের প্রায় ১৬০টিরও বেশি দেশে আজ ১৪ নভেম্বর পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) উদ্যেগেই প্রতিবছর এ দিবসটি পালন করা হয়। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘স্বাস্থ্য সম্মত খাবারই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়’। মূলত খাদ্য অভ্যাসের কারণে ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর আইডিএফ তাদের প্রতিপাদ্যের মধ্যেও বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক পুষ্টিবিদ হাসিনা আক্তার লিপি পূর্বকোণকে বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষেরই স্বাস্থ্যের আকৃতি/গঠন আলাদা। প্রত্যেকের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন অর্থাৎ শরীরের ওজন যদি বাঞ্ছিত ওজনে থাকে এবং বিএমআই যদি ১৮.৫ থেকে ২৪.৯ এর ভিতর থাকে, সে অনুযায়ী সারাদিনের খাবার যদি ক্যালরিটা জেনে-বুঝে খাওয়া যায় তবেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। দোকানের খাবার বা দাওয়াতের খাবার অথবা ফাস্টফুড খাওয়া যাবে না এমন নয়। তবে বুঝে খেতে হবে।
আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরাও : বর্তমানে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের বিরাট একটি অংশ প্রাপ্তবয়স্করা হলেও এ থেকে রেহাই পচ্ছেনা শিশুরাও। আজকাল শিশু ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তারাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার জন্য খাদ্য অভ্যাসকেই দায়ি করছেন বিশষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে পুষ্টিবিদ হাসিনা আক্তার বলেন, ‘আজকাল মায়েরা পড়ালেখা নিয়ে যতটা সচেতন ঠিক ততটাই অসচেতন স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যাপারে। ষ্কুলের টিফিনে দেয়া হচ্ছে বার্গার বা চিপস্। কিন্তু তাতে কত ক্যালরি আছে তা তারা জানেন না। তাই এসব বিষয়েও মায়েদের সচেতন হতে হবে। তবে জীবন থেকে মজাদার-মুখরোচক খাবার বাদ দিতে হবে এমনটিও নয়। বরং হিসেব করেই আদরের সন্তানকে খেতে দিতে হবে। তাহলে এ রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের এন্ড্রোক্রাইনোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার বলেন, এক সময় এ রোগে বয়স্করা আক্রান্ত হলেও বর্তমানে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তবে একটু সচেতন হলে এ রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব।
বাড়ছে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস : নগরায়ণ ও পরিবর্তিত জীবনধারণের কারণে যেমন ডায়াবেটিস বাড়ছে তেমনি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের অর্ধেকেরও বেশি পরে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এমনকি অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে শিশু অপুষ্টির শিকার হলে এবং সে শিশু পূর্ণবয়স্ক হবার পর অতিরিক্ত ওজন হলে তার ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি থাকে।
এ বছর আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন যখন নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে যাচ্ছে তার আগেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গর্ভধারণপূর্ব সেবা দিতে বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক পুষ্টিবিদ হাসিনা আক্তার লিপি বলেন, এরই মধ্যে সারা দেশে ’গর্ভধারণ-পূর্ব সেবাকেন্দ্র’ খোলা হয়েছে যেখানে নির্ধারিত সময়ে বিনামূল্যে ’গর্ভধারণ-পূর্ব পরামর্শ’ এবং স্বল্পমূল্যে গর্ভধারণ সংক্রান্ত সেবা পাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালেও এই সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রসবকালীন নারী ও শিশুমৃত্যুর হার যেমন কমানো সম্ভব হবে, তেমনি নারীসহ আগামী প্রজন্মকেও ডায়াবেটিসের ভয়াবহ প্রকোপ থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
আজকের কর্মসূচি : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতিসহ (বাডাস) বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ উপলক্ষে দেশব্যাপী ডায়াবেটিস সম্পর্কিত সচেতনতামূলক পোস্টার, লিফলেট বিতরণ ছাড়াও র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। সকাল সাড়ে আটটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে শহীদ শাহ আলম বীর উত্তম অডিটোরিয়ামে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা ও র্যালি। এছাড়া বিনামূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষাও করা হবে হাসপাতালের এন্ড্রোক্রাইনোলজি বিভাগে। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা ও র্যালি। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও সংগঠনের উদ্যোগেও দিবসটি পালিত হত যাচ্ছে ।