চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫

সর্বশেষ:

জৌলুস হারালেও কদর কমেনি ‘হালখাতার’
লাল কাপড়ের বাঁধাইয়ে হালখাতা

জৌলুস হারালেও কদর কমেনি ‘হালখাতার’

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৩ এপ্রিল, ২০২৫ | ৯:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার আগে খাতুনগঞ্জে খাতা বাঁধাইয়ের ব্যবসা শুরু করেন পটিয়া ধলঘাট এলাকার স্বদেশ রঞ্জন ঘোষ। লাল কাপড়ের বাঁধাইয়ে মোটা আকারের বিশেষ খাতা বানানোর খ্যাতি রয়েছে তাঁর দোকানের। বংশ পরম্পরায় এ ব্যবসা করে আসছেন তাঁর চার সন্তান ও নাতিরা। নতুন বছরের ‘হালখাতার’ চাহিদা বাড়ে দোকানে।

 

স্বদেশ রঞ্জনের তৃতীয় প্রজন্ম অধীশ রঞ্জন ঘোষ (নয়ন) বললেন, ‘ঠাকুরদার (দাদা) আমল থেকে খাতা তৈরির ব্যবসা করে আসছে তাদের পরিবার। এবার নববর্ষ উপলক্ষে ‘হালখাতার’ চাহিদা ও ব্যবসা ভালো হয়েছে। মান ভালো থাকায় চট্টগ্রাম ছাড়াও কক্সবাজার ও সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় তাদের খাতার কদর রয়েছে।’ তিনি বলেন, এক হাজার থেকে ১২০০ পৃষ্ঠার খাতা বানানো হয়। বড় ব্যবসায়ীদের বড় আকারের খাতার চাহিদা রয়েছে।

 

বিশ্বায়নের যুগে তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ। ব্যাংক লেনদেন থেকে শুরু করে পণ্য আমদানি-রপ্তানি- সবই হচ্ছে অনলাইনে, প্রযুক্তির মাধ্যমে। তারপরও যুগ যুগ ধরে চলে আসা মান্ধাতা আমলের লাল কাপড়ের বাঁধাইয়ে হালখাতার চাহিদা ও কদর কমেনি।

 

খাতা তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা বললেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে লেনদেন ও আমদানি-রপ্তানি নিমিষেই করার সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বেচাকেনায় এখনো খাতায় লেখালেখির প্রচলন চালু রয়েছে। কারণ শত শত কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাকির বিষয় খাতায় লিখা রাখা নিরাপদ মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

 

বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ নববর্ষে জাঁকজমকভাবে খোলা হয় নতুন খাতা। ব্যবসায়ীদের কাছে যা হালখাতা নামে পরিচিতি। আজ চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষদিন। পুরোনো বছরের হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে কাল পহেলা বৈশাখ থেকে খোলা হবে এ হালখাতা। আবহমানকাল থেকে এ হালখাতার প্রচলন চলে আসছে।

 

দেশের ভোগ্যপণ্যের পুরোনো ও বড় পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে এখনো জিইয়ে রয়েছে ‘হালখাতা’ উৎসব। তবে হালখাতার জৌলুস এখন অনেকটা ম্রিয়মান বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

 

বাংলা সনের প্রথম দিন হিসাব-নিকাশের হালনাগাদ করেন ব্যবসায়ীরা। এই উপলক্ষে দোকান-ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে ধুয়ে-মুছে শুচি করা হয়। ফুল, নিমপাতাসহ নানা রঙের ফুল দিয়ে রাঙানো হয়। বছরের বেচাকেনা থেকে শুরু করে লাভ-লোকসান এবং বাকির হিসাব চুকিয়ে নেন। ধর্মীয় আচারে মোটা মলাটের লাল খাতায় নতুন বছরের হিসাবের সূচনা করা হয়। এসময় দোকানে দোকানে চলে নানা পদের মিষ্টান্ন খাওয়ার রীতি। ঠাণ্ডা পানীয় ও চা-নাস্তার আয়োজন। প্রাণোচ্ছ্বস-হৃদ্যতায় মেতে ওঠেন ব্যবসায়ীরা।

 

বছরের শেষদিন মাঙ্গলিক আয়োজনে হালখাতার ‘মহরত’ করা হয়। বছরের দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে ফেলা হয়। বছরের প্রথম দিনের শুভক্ষণে খরিদ্দারদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তোলার রেওয়াজ আবহমানকালের ঐহিত্য।

 

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সকালে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে লালখাতার শুভ উদ্বোধন করেন। বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন। প্রার্থনা করতেন, সারা বছর যেন ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যায়। অন্য ধর্মীবলম্বীরাও ধর্মীয় আচারে নতুন হিসাব খোলেন।

 

বাণিজ্যপাড়া চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ছাড়া গ্রাম-গঞ্জেও হালখাতা উৎসবে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আন্তরিকতায় ভরপুর থাকে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের পুরোনো সর্ম্পক নতুন রূপে রাঙিয়ে নেওয়ার রেওয়াজ আবহমান থেকে চলে আসছে।

 

প্রায় ৬২ বছর ধরে চাক্তাইয়ে ব্যবসা করে আসছেন হারুনুর রশিদ। চাক্তাই শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমাদের সময়ে ব্যবসায়ীরা অতি জাঁকজমকভাবে হালখাতা উৎসব পালন করা হতো। কয়েক দিন আগ থেকে প্রস্তুতি চলতো। পাওয়া টাকার হিসাব দিয়ে চিঠি লেখা হতো। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন। পুরোনো দেনা-পাওনার হিসাব শেষ করে নতুন বছরে নতুন হিসাব খোলা হয়। মিষ্টিমুখ করা হয়। এক অন্য রকম আনন্দ-উৎসব ছিল। কারণ সেই সময়ে ৮০ শতাংশ লেনদেন হতো বাকিতে।’

 

কালের বিবর্তনে হালখাতার জৌলুস হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি জাত ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ বলেন, ৮০-৯০ দশকের পর থেকে হালখাতার উৎসবে ভাটার টান পড়ে। কারণ বিশ্বাসের ব্যবসায় অবিশ্বাস ভর করেছে। প্রতারণা বেড়ে যায়। বাকিতে লেনদেন কমে আসে। ব্যাংকে লেনদেন বেড়েছে। এতে হালখাতার জৌলুসও কালের আবর্তে অনেকটা ম্লান হয়ে পড়ে।

 

যেভাবে হালখাতা শুরু

মোগল আমলে খাজনা আদায় করা হতো হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে। কিন্তু হিজরি বর্ষপঞ্জি চন্দ্র মাসের হিসাবে হওয়ায় কৃষি খাজনা আদায়ে অসুবিধা হতো। খাজনা আদায়ে শৃঙ্খলা আনা ও প্রজাদের অনুরোধে সম্রাট আকবর বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে বাংলা সালের সংস্কার আনার নির্দেশ দেন। তিনি সেই নির্দেশ অনুসারে হিন্দু সৌর ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম নির্ধারণ করেন। বাংলা সালের ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত মনে করেন ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

Close