চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

বড় চ্যালেঞ্জ, বিস্ময়কর সাফল্য

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১২:৪৫ অপরাহ্ণ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

 

শুরুটা কাকতালীয়। তবে উত্থান অবিস্মরণীয়। এ দেশে দ্রুত বিকাশ ঘটেছে জাহাজভাঙা শিল্প। ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের প্রধান উৎস হচ্ছে এ জাহাজভাঙা শিল্প। এছাড়াও জাহাজনির্মাণসহ আরও একাধিক শিল্পের কাঁচামালের জোগান দেয় এ শিল্প। রড উৎপাদনে বছরে ২৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টন লোহার জোগান আসে এ খাত থেকে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০০১-০২ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত গত ২০ বছরে চট্টগ্রামের শিপ ইয়ার্ডগুলোতে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৯টি। আমদানি করা এ জাহাজগুলো থেকে মোট ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭ টন স্ক্র্যাপ কাটা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে যত জাহাজ আমদানি হয়েছে, তার শুল্ক-করসহ আমদানি মূল্য ছিল ৯ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ জাহাজভাঙা শিল্প দ্রুত বিকাশ ঘটলেও পার করতে হয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ ও সংকট। পরিবেশ দূষণ, শ্রম দাসত্ব, সরকারের শিল্প নীতিমালা ও হংকং কনভেনশন নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে এ শিল্প খাত। তারপরও আশা জাগাচ্ছে, ২০২৩ সালের মধ্যে পরিবেশবান্ধব ইয়ার্ডে রূপান্তর করতে হবে সকল ইয়ার্ডকে। বর্তমানে পরিবেশবান্ধব ইয়ার্ড হচ্ছে মাত্র একটি। আরও ৮-১০টি ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স এন্ড রি-সাইক্লার্স এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি শিল্পপতি আলহাজ কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পুরোনো জাহাজ কাটা থেকে স্ক্র্যাপ ছাড়াও হাজার রকম পণ্যের বিশাল বাণিজ্য গড়ে উঠেছে দেশ-বিদেশে। এ খাত থেকে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে। দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে’।

জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনের নিবন্ধিত ইয়ার্ডের সদস্য সংখ্যা ১৬০টি। বর্তমানে চালু আছে অর্ধ শতাধিক। তবে জাহাজ কাটাকাটি হচ্ছে ২৫-৩০টি ইয়ার্ডে। ২০১০ সাল-পরবর্তীতে এ ব্যবসা বড় ধাক্কা খায়। ব্যাংক ঋণের উচ্চ হারের সুদ ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলাতে না পারায় অনেক ইয়ার্ড ঋণখেলাপি আর দায়-দেনায় জর্জরিত হয়ে গুটিয়ে যায়।

বিএসবিআরএ’র তথ্য, গতবছরে (২০২১ সাল) পুরোনো জাহাজ আমদানি হয়েছে ২৮০টি। এসব জাহাজ থেকে স্ক্র্যাপ লোহা হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ ২৯ হাজার টন। ২০২০ সালে আমদানি হয়েছে ১৫০টি। লোহা হয় ১৯ লাখ ২ হাজার টন। ২০১৯ সালে ২৪০টি জাহাজ থেকে স্ক্র্যাপ হয় ২৫ লাখ ৬৯ হাজার টন। ২০১৮ সালে ১৯৬টি জাহাজ থেকে স্ক্র্যাপ হয়েছে ২৫ লাখ ৮১ টন। ২০১৭ সালে ১৯৮টি জাহাজ থেকে স্ক্র্যাপ হয়েছে ২১ লাখ ৩৪ টন। ২০১৬ সালে ২৩৭টি জাহাজ থেকে স্ক্র্যাপ হয়েছে ৩১ লাখ ৫৮ হাজার টন।

বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স এন্ড শিপ রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের সচিব মো. নাজমুল ইসলাম জানান, ‘জাহাজ ভেঙে স্ক্র্যাপ লোহা না পাওয়া গেলে দেশের ইস্পাত শিল্পে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো। এখন সে ক্ষতি পুষিয়ে দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে’।

১৯৬০ সালে সীতাকুণ্ড উপকূলীয় অঞ্চলে এ শিল্পের হাতেখড়ি। এই শিল্পে বর্তমানে অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই লাখের অধিক মানুষ জড়িত রয়েছে। জাহাজ রিসাইকেলে (পুনর্ব্যবহার) তিন বছর ধরে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি জাহাজ রিসাইকেল হয় এ দেশে। গত বছরও শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখে।

জাহাজভাঙা শিল্প মালিক সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিন বলেন, এ শিল্পের বড় বাধা হচ্ছে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ ও ভ্যাট-ট্যাক্স বিভাগ। বিদেশে ২-৩ শতাংশের ওপরে ব্যাংক সুদ নেই। আর বাংলাদেশে সর্বনিম্ন সুদ ৯ শতাংশ। আগে ছিল ১২ শতাংশ। সুদের হার কমানোর জন্য সরকারের কাছে আমরা অনেক দেন-দরবার করেছি। সুফল পাইনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এটিই একমাত্র শিল্প, অগ্রিম ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে জাহাজ আমদানি করতে হয়। কিন্তু এখন জাহাজের বিভিন্ন পণ্যের ওপর ফের আলাদা করে ভ্যাট-ট্যাক্সের জন্য চাপাচাপি ও হয়রানি করা হচ্ছে। তার উত্তরণ না হলে জাহাজভাঙা ব্যবসা সংকটের মুখে পড়বে।

দেশে আন্তর্জাতিকমানের একমাত্র গ্রিন শিপ ইয়ার্ড হল পিএইচপি শিপ ব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, ‘২০২৩-২৪ সালের মধ্যে প্রতিটি ইয়ার্ডকে হংকং কনভেনশন আদলে পরিবেশবান্ধব ইয়ার্ডে রূপান্তর করতে হবে’। তিনি বলেন, ‘এখন ইয়ার্ডগুলোতে ম্যাগনেটিক ও টাওয়ার ক্রেনসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্তত তিন শ জন শ্রমিকের সমান কাজ করছে একটি ক্রেন। এতে শ্রম দাসত্বের বদনামও কিছুটা ঘুচাতে যাচ্ছে’।

জাহাজভাঙা শিল্প বিস্ময়কর সাফল্য দেখালেও পরিবেশ দূষণ, শ্রম দাসত্ব ও দুর্ঘটনা পিছু ছাড়ছে না। ছোট-বড় দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা লেগেই রয়েছে। অথচ ২০০৯ সালের মার্চ মাসে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) প্রোগ্রাম অফিসার ফজলুল কবির মিন্টু বলেন, ‘এই শিল্পে কমর্রত শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পেশাগত নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো কোন ইয়ার্ডই কার্যকর করেনি’।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন