চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

অনুকরণীয় জীবনগাঁথা ইউসুফ চৌধুরী

এম. নাসিরুল হক

২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ৩:০১ অপরাহ্ণ

মানুষের জীবনটা হচ্ছে একটা যুদ্ধ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে বেঁচে থাকতে হয় যুদ্ধ করে। যার যেখানে জন্ম বা অবস্থান, তাকে সেই অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। তেমনি একজন যোদ্ধা হচ্ছেন দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী।

ইউসুফ চৌধুরীর জন্ম ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। জাতীয় কবি নজরুল রাউজান এসেছিলেন  ১৯৩৩ সালে। আসার কারণ ছিল সাহিত্য সম্মেলন। এই সম্মেলনে এসে কাজী নজরুল ইসলাম তিন রাত, দুই দিন অবস্থান করেছিলেন ইউসুফ চৌধুরীদের কাচারী ঘরে। কবি আগমনে হাজী বাড়ি যেমন ধন্য হয়েছে তেমনি আলহাজ ইউসুফ চৌধুরীর কারণেও ধন্য হাজী বাড়ি।

ছাত্রজীবন শেষ করে তিনি প্রথমে রাউজানের ফকিরহাটে পাঠকবন্ধু নামে একটি বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম শহরে এসে জুবিলী রোডে নিউজফ্রন্ট নামে বইয়ের ব্যবসার পাশাপাশি ঢাকা ও করাচি থেকে প্রকাশিত পত্রিকার এজেন্সি নেন। এসময় তার বন্ধু একজন তার এ ব্যবসার পার্টনার ছিলেন। তাকে আমরা দুদু মামা বলে ডাকতাম। সেই মামা শেষ পর্যন্ত ব্যবসায় টিকে থাকেত পারেননি। ইউসুফ চৌধুরী এটাই সে ব্যবসা চালিয়ে যান।

ইউসুফ চৌধুরীর জীবনের কয়েকটি ঘটনা হয়ত আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য শিক্ষনীয় হতে পারে। বইয়ের ব্যবসার পেছনে তাঁর পরামর্শদাতা ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতি আলহাজ আহমদ চৌধুরী। সম্পর্কে তিনি আমার জেঠা। তিনি ৩০-এর দশকের বিএবিটি এবং আরবীতে উলা পাস করেন। তাঁর কথা ছিল বইয়ের ব্যবসায় একটা স্বপ্নতো আছে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি বইয়ে দাম লেখা থাকে। সেখানে ক্রেতার ঠকার কোন সুযোগ নেই। কমিশন পাবে ব্যবসায়ী। এই স্বচ্ছতাকে পুঁজি করেই তাঁর নিউজ ফ্রন্টের অগ্রযাত্রা। এই নিউজ ফ্রন্টে ৫০-এর দশকে এবং ’৬০-এর দশকের এমন কোনো ভাল ছাত্র নেই যারা নিউজ ফ্রন্টে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বই পড়েনি। এর সাথে থাকত দৈনিক পত্রিকা ও দেশি-বিদেশি ম্যাগাজিন তাঁর দোকানে।

ইউসুফ চৌধুরী অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় তার কার্যক্রমে। একদিন আমি কি একটা কাজে সকালে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। বাসায় গিয়ে কলিং বেল টিপে ভিতরে ঢুকে চাচার কাছে জানতে পারলাম তিনি বাসায় নেই। চাচীকে বললাম, বাইরে ওনার গাড়ি দেখছি। চাচী বললেন, ড্রাইভার নাতিদের স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গাড়ি আসতে দেরি করায় তিনি নেমে ট্যাক্সি করে কাজে চলে গিয়েছেন।

আর একবার নজরুল জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে তাঁর অফিসে বাড়ির ভাইপোদের ডেকেছিলেন তিনি। সময় ছিল সন্ধ্যাা ছ’টা। আমি একটু দেরিতে পৌঁছেলিাম সেখানে। তিনি আমাকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, তোমাদের ছ’টা এখন বাজে? তিনি বলেন, আমরা যদি সময়কে মূল্য না দেই তাহলে জীবনের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ-খরচ করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। যেমন তিনি তাঁর তিন ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। ভাল শিক্ষা দেয়ার জন্য ভাল স্কুল ও বাসায় ভাল শিক্ষক নিয়োগ করতে ভুল করেননি।

ইউসুফ চৌধুরী পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে সিগনেট প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ছোট আকারের প্রতিষ্ঠানটি এক সময় চট্টগ্রামে এক নম্বর প্রেসের তকমা লাভ করে এবং এখনো সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।

’৭০-এর দশকের শেষে দিকে দোলনা ডাইজেস্ট নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে ‘প্রভাতী’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা সে সময় বিভিন্ন কারণে করা না হলেও ১৯৮৬ সালে তিনি দৈনিক পূর্বকোণ বের করেন, যা চট্টগ্রামের সংবাদ শিল্পে একটি নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। পূর্বকোণ বের হবার পর চট্টগ্রামের অন্যান্য পত্রিকাগুলোও তাদের প্রিন্টসহ অন্যান্য বিষয়ে নতুন কিছু সংযোজন করতে বাধ্য হয়। তাঁর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ভালবাসায় সিক্ত দৈনিক পূর্বকোণ আজো অত্যন্ত সুনামর সাথে চট্টগ্রাম ও আশেপাশের জেলাগুলোর মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বলে যাচ্ছে।

এক সময় তাঁর বেয়াই ছিলেন পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব। সচিব সাহেব ইউসুফ চৌধুরীর খুলশি বাসায় এসে দেখলেন সামনে বেশ খালি জায়গা রয়েছে। তিনি তখন ইউসুফ চৌধুরীকে বলেন, আপনি চাইলেতো এখানে একটি গরু পালতে পারেন। যা থেকে আপনার ঘরের দুধের চাহিদা মিটে যাবে। আলাপ-আলোচনার পর সচিব সাহেব বেয়াইকে (ইউসুফ চৌধুরীকে) একটি বকনা বাচুর উপহার দিলেন। ইউসুফ চৌধুরী পরে বুঝতে পারলেন এত একটি সোনার খনি তা থেকে প্রচুর সোনা আহরণ করা যায়। ঐ গাভীর পরিচর্চা করার প্রয়োজনে প্রচুর লেখা পড়া করলেন। এক পর্যায়ে তিনি কালুরঘাট এলাকায় সুপার ডেইরি নামে একটি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করলেন। আজো সেই সুপার ডেইরি চট্টগ্রামের মানুষদের দুধ সরবরাহ করে যাচ্ছে।

ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন একজন প্রকৃত নজরুল ভক্ত মানুষ। জাতীয় কবি নজরুলের স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বেশ কয়েকবার নজরুলজয়ন্তী উদযাপন করেছেন হাজীবাড়িতে। সেখানে মন্ত্রী ও বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পীরা ঢাকা থেকে এসে আয়োজনকে সৌন্দর্যম-িত করেছিলেন। নজরুল স্মৃতিধন্য হাজী বাড়িতে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি লাইব্রেরি। নজরুল সম্পর্কে জানার ব্যাপারে এই লাইব্রেরি এখন ভূমিকা রাখছে।

চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠিত বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জনাব ইউসুফ চৌধুরী। চট্টগ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় সময় তার অফিসে এই সংস্থার বৈঠক অনুষ্ঠিত হত। সংগ্রাম কমিটির সভা করার জন্য তিনি সন্দ্বীপ ও কক্সবাজার পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন।

চট্টগ্রামের ভেটেরেনারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার ক্ষেত্রে তার উদ্যোগ ছিল অপরিসীম। এই কলেজকে বিশ^বিদ্যালয়ে উন্নত করার জন্য তিনি চট্টগ্রামের আপামর জনগোষ্ঠীর সাথে সভা করে একটি জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং জনগণের সহযোগিতায় বিশেষ করে তৎকালীন মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান ও সচিব আবদুল করিমের আন্তরিকতা ভেটেরেনারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। দেশের পশু সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় আজ ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষে মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর একাডেমিক ভবনের নামকরণ করে আমাদেরকে ধন্য করেছে। ইউসুফ চৌধুরীর জীবন নিয়ে গবেষণা করার মত উপাত্ত রয়েছে তার কর্মকান্ডে। জন্মশত বার্ষিকীতে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট