খুঁটি বিদ্যুৎ বিভাগের। তবে সেখানে শুধু বিদ্যুতের নয়-টাঙানো হয়েছে ইন্টারনেট, ডিশ, টেলিফোনসহ নানা বেসরকারি পরিষেবার তার। বছরের পর বছর ধরে ‘যেমন খুশি তেমন স্টাইলে’ এই কাজ চলতে থাকায় নগরীর প্রায় সব বৈদ্যুতিক খুঁটিতে তারের জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও ‘জটাতারের’ ভারে নুয়ে পড়েছে বৈদ্যুতিক খুঁটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে নানা পরিষেবার তার টাঙানো কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। পরিষেবা কোম্পানিগুলোকে তার সরাতে দফায় দফায় তাগাদা দেওয়া হলেও মিলছে না সাড়া। বরং তার টাঙানোর পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ফলে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে শর্ট সার্কিটে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ঘটছে প্রাণহানি। ম্লান হচ্ছে নগরীর সৌন্দর্য। অন্যদিকে বেসরকারি পরিষেবা কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তারা ‘বাধ্য হয়েই’ বৈদ্যুতিক খুঁটি ব্যবহার করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করে দেওয়া হলে তারা দ্রুত বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে নিজেদের তার সরিয়ে নেবেন। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে চট্টগ্রাম নগরীর তারের জঞ্জাল সরাবে কে? আর সরবেই বা কবে?
সূত্র জানায়, প্রায় ৬০ বর্গমাইলের চট্টগ্রাম নগরীতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ৩ হাজার কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন আছে। বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে সম্প্রতি সঞ্চালন লাইনের সব ঝুলন্ত তার সরানোর নির্দেশনা দেয় আদালত। এর প্রেক্ষিতে পিডিবি সব তার মাটির নিচে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান- নগরীতে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন খুঁটি থেকে সরিয়ে মাটির নিচে নিতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। ‘চট্টগ্রাম জোনে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প-২’ নামের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মাটির নিচ দিয়ে যাবে তার। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। প্রকল্পটির মাধ্যমে শুধু বিদ্যুতের তার মাটির নিচ দিয়ে যাবে। বেসরকারি পরিষেবাগুলোর তার উপরেই থাকবে। ফলে যে উদ্দেশ্যে মাটির নিচ দিয়ে তার নেওয়ার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে- সেটি অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। বেসরকারি পরিষেবাগুলোর তার মাটির নিচ দিয়ে নেওয়ার জন্য আলাদা একটি প্রকল্প নেওয়ার প্রস্তাব তাদের।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিন হোসাইন পূর্বকোণকে বলেন, ঢাকা ও সিলেটের কিছু অংশে সব ধরনের তার মাটির নিচ দিয়ে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামেও একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে শুধু বিদ্যুতের তার মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে গেলে হবে না। ভাড়া নিয়ে হলেও অন্য পরিষেবাগুলোর তারও নিতে হবে। তবেই সুফল মিলবে।
গতকাল নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোতে তারের জঞ্জাল ঝুলছে। নিউমার্কেট, রিয়াজউদ্দীন বাজার, আগ্রাবাদ, চকবাজার, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, ষোলশহর, ২ নম্বর গেট, টাইগারপাস, জামাল খান, আন্দরকিল্লাসহ পুরো নগরীজুড়ে একই চিত্র দেখা গেছে। বিভিন্ন সময়ে এসব তার ছিঁড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আগ্রাবাদ বিভাগীয় কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট- গত এই আট মাসে চট্টগ্রামে শুধু বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই ১৮৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ৩ কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে। এছাড়া একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। আহত হয়েছেন দুই জন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আগ্রাবাদ বিভাগীয় কার্যালয়ের মুবিলাইজিং অফিসার কফিল উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, চট্টগ্রামে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে যেসব অগ্নিকাণ্ড ঘটে তার বড় অংশের উৎস বৈদ্যুতিক খুঁটি। বৈদ্যুতিক খুঁটি তারের জঞ্জালমুক্ত করা গেলে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি এড়ানো যেত।
বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান সামিনা বানু পূর্বকোণকে বলেন, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে ইন্টারনেট, ডিশসহ বিভিন্ন বেসরকারি পরিষেবার তার সরাতে আমরা নানা সময়ে অভিযান পরিচালনা করি। একদিকে তার সরানো হলে অন্যদিকে ফের টাঙানো হয়। সব তার সরাতে আমরা দ্রুত চিঠি ইস্যু করবো। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ইন্টানেট, ডিশ সেবা দিয়ে ব্যবসা করছেন। মোটা অঙ্কের টাকা আয় করছেন। তারা কীভাবে গ্রাহকদের নিরাপদে সেবা দেবেন সেই প্রস্তুতি তাদের থাকা উচিত। সরকার কেনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করে দেবে? বৈদ্যুতিক খুঁটিতে তারের জঞ্জাল পেলে আমরা অপসারণে অভিযান পরিচালনা করবো।
পূর্বকোণ/এসি