চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

চট্টগ্রাম কাস্টমস: জরিমানা-শাস্তিতেও কমছে না মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি

সারোয়ার আহমদ 

১১ জুন, ২০২১ | ১২:৫৩ অপরাহ্ণ

ফৌজদারি মামলা, কমপক্ষে দ্বিগুণ থেকে সর্বোচ্চ চারগুণ জরিমানা এমনকি লাইসেন্স বাতিল করেও দমানো যাচ্ছে না মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির প্রবণতা। নানা ছল-চাতুরি ও নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে জালিয়াত চক্র এক পণ্যের ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য। উপরন্তু সম্পূর্ণ বিনা শুল্কের পণ্যের আড়ালেও কৌশলে নিয়ে আসে উচ্চ শুল্কের পণ্য। একই সাথে আসে বৈধ পণ্যের আড়ালে অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত পণ্যও। আর এ ধরণের প্রতিটি চালানের নেপথ্যে থাকে সরকারি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা।

গত সাড়ে পাঁচ মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ এমন ৮টি চালান আটক করে। গত ১১ মাসে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় সিএন্ডএফ এজেন্টসের ৪২টি লাইসেন্স এবং বাতিল করা হয় তিনটি।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্যের মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে ২টি, ফেব্রুয়ারিতে ২টি, মার্চে ১টি, এপ্রিলে ১টি এবং চলতি জুনের প্রথম সপ্তাহেই ২টি চালান আটক করে। ওই সব চালানের আড়ালে প্রায় শত কোটি টাকার সরকারি রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে জালিয়াতি চক্র। তাদের বিরুদ্ধে করা ফৌজদারি মামলায় শাস্তি ও লাইসেন্স বাতিলের মত পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও অন্য জালিয়াতি চক্রের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে না। নানা ফাঁক-ফোকর খুঁজে একের পর এক জালিয়াতির চেষ্টা করা হচ্ছে।

কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ৬ জানুয়ারি বুধবার রাতে শুল্কমুক্ত কাঁচা তুলা আমদানির ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা উচ্চ শুল্কের সোফার কাপড় কাপড়ের একটি চালান আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টমসের শুল্ক গোয়েন্দা শাখা। ওই চালানে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে জালিয়াতি চক্র। নগরীর জুবলি রোডের মেসার্স ইএন এন্টারপ্রাইজ নামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চীন থেকে দুটি কন্টেইনারে ৪১ হাজার ১২০ কেজি কাঁচাতুলা আমদানির ঘোষণা দিয়ে সাড়ে ৪ টন সোফার কাপড় নিয়ে আসে। পণ্য খালাসে সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান প্রগতি কার্গো সার্ভিস এর প্রতিনিধিরা গোপনে দুটি কনটেইনার খুলে পণ্য ট্রাকে লোড করে খালাসের পূর্বেই কাস্টমসের কর্মকর্তারা তাদের পণ্যসহ আটক করে।

পরবর্তি ১৩ জানুয়ারি বুধবার গার্মেন্টসের কাঁচামাল আমদানির ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দরে আনা ৪০ টন পর্দা ও সোফার কাপড় আটক করে কাস্টমস। ওই চালানেও প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ঈশ্বরদী ইপিজেডের নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড এর নামে চট্টগ্রাম বন্দরে দুই কনটেইনারে পোশাক শিল্পের কাঁচামালের (ব্লিচড ফেব্রিক্স) ঘোষণায় সেদিন দেড় কোটি টাকার ৪০ টন পর্দা ও সোফার কাপড় আসে।

এরপর, গত ৭ ফেব্রুয়ারি রবিবার চট্টগ্রাম বন্দরে পুরনো বৈদ্যুতিক তাঁতের (পাওয়ার লুম) ঘোষণায় আনা তিন কনটেইনারে থাকা সার্কিট ব্রেকার, উচ্চ শুল্কের বিভিন্ন প্রকার কসমেটিক ও পর্দার কাপড় জব্দ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। নারায়ণগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স সোহেল টেক্সটাইল দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পুরনো বৈদ্যুতিক তাঁতের ঘোষণায় আমদানি করে ৬৯ হাজার ৫৬৯ কেজি সেকেন্ড হ্যান্ড (ব্যবহৃত) ক্যাপিটাল মেশিনারি। শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় পুরাতন আমদানি নিষিদ্ধ প্রায় ৩৯ হাজার ৮৫০ কেজি সার্কিট ব্রেকার ও উচ্চ শুল্কের বিভিন্ন প্রকার কসমেটিক সাবান, শ্যাম্পু, বডি লোশন, ফেস ক্রিম, শাওয়ার জেল ও পর্দার কাপড় পাওয়া যায় ওই চালানে।

একই মাসের ৭ তারিখ শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা কনটেইনার ভর্তি পাঁচ কোটি টাকার বিদেশি সিগারেটের একটি চালান জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা। যেখানে পলিয়েস্টার পিইটি স্ট্র্যাপ এর পরিবর্তে পাওয়া যায় ৪৮ লাখ ২৮ হাজার শলাকা বিদেশি সিগারেট। পাবনার ঈশ্বরদী এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ঈশ্বরদী ইপিজেড) এলাকার প্রতিষ্ঠান ফুজিয়ান এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ঘোষণা বর্হিভূত আনা চালানে ন্যানো ওরিস, ব্ল্যাক, ডানহিল ও ডেবিডঅফ ব্রান্ডের ৪৮ লাখ ২৮ হাজার শলাকা সিগারেট পাওয়া যায়।

এরপর ১২ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে গত ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে কাগজের আড়ালে আনা হয় বিদেশি সিগারেট। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এ-ফোর সাইজের কাগজ ঘোষণায় ওই পণ্য আমদানি করে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মায়ানীড়। চালানটির শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে মোট ২৪ হাজার ৯৯০ কার্টনে ওরিস ও মন্ড ব্রান্ডের বিদেশি সিগারেট পায় কাস্টমস। যার মাধ্যমে আমদানিকারক প্রায় ১২ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা চালায় জালিয়াতি চক্র।

এরপর গত ২১ এপ্রিল বুধবার হংকং থেকে আনা আরেকটি চালান আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ওই চালানের পণ্যের আঁড়ালে বিদেশি মদ ও সিগারেট পায় কাস্টমস। নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডর প্রতিষ্ঠান মাজেন (বাংলাদেশ) ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড হংকং থেকে উৎপাদন সরঞ্জামাদি, নির্মাণ সরঞ্জাম, প্যাকিং উপাদান, খাদ্য সামগ্রী ইত্যাদি ঘোষণা দিয়ে এক কনটেইনার পণ্য আমদানি করেন। কিন্তু কাস্টমসের কায়িক পরীক্ষায় ওই চালানে চকলেট, কেক, কফি, বাদাম, চিনি, পানি, সুপ ইত্যাদি ছাড়াও ঘোষণা বহির্ভূতভাবে আনুমানিক সাড়ে ২৬ লিটার মদ, ১০ হাজার ২শ শলাকা সিগারেট ও ১ কেস বিয়ার পাওয়া যায়। সেই চালানটি খালাসে নিয়োজিত ছিল আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডের সিএন্ডএফ এজেন্ট মল্লিক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

এরপর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেও আটক করা হয় আরো দুটি চালান। এর মধ্যে একটি আটক হয় ১ জুন মঙ্গলবার। সেদিনের চালানে মালয়েশিয়া থেকে আনা সরিষা বীজের পরিবর্তে পাওয়া যায় ৪২ টন আফিম তৈরির উপকরণ পপি বীজ। যেখানে কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করে আমদানিকার। পুরান ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আজমিন ট্রেড সেন্টার ওই চালানের আমদানিকারক। চালানটি খালাসে মনোনীত সিএন্ডএফ এজেন্ট ছিল হটলাইন কার্গো ইন্টারন্যাশনাল।

সর্বশেষ গত ৩ জুন বৃহস্পতিবার সাড়ে ১৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আনা প্লাস্টিক হ্যাঙ্গারের চালানের ৩শ কার্টন বিদেশী সিগারেট জব্দ করে কাস্টমস। রাজধানীর সাভারের রাজ ফুলবাড়িয়া এলাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ভার্সেটাইল আট্টিরে লিমিটেড চায়না থেকে ওই চালান আমদানি করে। খালাসের কাজে নিয়োজিত সিএন্ড এফ ছিল আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডের সিএন্ডএফ এজেন্ট জয়িতা ট্রেড কর্পোরেশন।

এসব জালিয়াতি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের অডিট ইনভেস্টিগেশন এন্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখার সহকারী কমিশনার রেজাউল করিম পূর্বকোণকে বলেন, এক শ্রেণির জালিয়াতি চক্র আছে যারা সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানির কাজ করে। প্রায় সময় এমন কিছু মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্য আটক করে কাস্টমস। যেগুলাতে অভিনব কায়দায় লুকানো পণ্য পাওয়া যায়। যেখানে বৈধ- অবৈধ অনেক পণ্য পাওয়া যায়। ওই সব জালিয়াতি চক্রদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে শাস্তি দেওয়া হয়। দ্বিগুণ থেকে সর্বোচ্চ চারগুণ পর্যন্ত জরিমানাও করা হয়। এমনকি তাদের লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হয়। এসবের পরেও কিছু কুচক্রী মহল এসব জালিয়াতি চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন