চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

আমাদেরও সাধ জাগে…

জাহেদুল আলম, রাউজান

১৩ মার্চ, ২০২১ | ১:২০ অপরাহ্ণ

দু’চোখ আলোয় ভরে তোমরা যারা…সুন্দর আগামীর পথে চলো…আমাদেরও সাধ জাগে তোমাদেরও সাথী হতে…আমাদের নিয়ে চলো…প্রতিবন্ধী বলো না…আমাদের মানুষ বলো….’। সুললিত কণ্ঠে হৃদয়স্পর্শী এই নাত পরিবেশন করছিলেন কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী।

কারো বয়স ১৩, কারো ২০-২২। কেউ জন্মান্ধ, কেউবা আবার অল্প বয়সে টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্ধত্ব বরণ করেছেন। চোখ থেকেও বাকি জীবন তাদের কাটাতে হবে কালো বিদঘুটে পৃথিবী দেখে। এসব দৃষ্টিহীন শিশু-কিশোর, যুবককে পৃথিবীর বুকে স্বপ্নীল, রঙ্গিন ভুবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, ‘আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’র পরিচালনাধীন ‘আল মানাহিল একাডেমি’ (অনাথ, এতিম ও দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষায়িত)।

চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক ঘেঁষে রাউজান-কাউখালী সীমান্তের গোদার পাড় বেতবুনিয়া এলাকায় গড়ে উঠা এই কমপ্লেক্স যেন নীরব এক ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান। এখানে সমাজের বঞ্চিতদের যোগ্য করতে, অন্য দশজন সুস্থ মানুষদের মতো বেঁচে থাকার অধিকার ফিরিয়ে দিতে চলছে এক নিরন্তন সংগ্রাম। আল মানাহিল একাডেমিতে অন্তত ৫০ শিক্ষার্থীকে বিশেষ পদ্ধতির (‘ব্রেইল পদ্ধতি) মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে পাঠদান। শেখানো হচ্ছে কোরআন শিক্ষা, বাংলা, ইংরেজি, হাদিস, হাফেজ শিক্ষা।

ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করতে এবং দেশের সকল অঞ্চলের অন্ধ, প্রতিবন্ধী, এতিমদের জ্ঞানের আলো দিয়ে নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে এখানে ভরনপোষণসহ বিনামূল্যে রেখে পাঠদান দেয়া হচ্ছে। শুধু অন্ধদের ব্রেইল পদ্ধতিতে পাঠদানই নয়, বিশাল এই কমপ্লেক্সে চারটি সেকশনে চলে পাঠদান। সেগুলো হলো কিতাবখানা, হেফজখানা, নুরানী ও অন্ধদের শিক্ষাদানের সিলেবাস। চারটি বড় পৃথক ভবনে চলে শিক্ষাদান। আবাসিক-অনাবাসিক মিলে এখানে মোট ছাত্র রয়েছে সোয়া ৩শ। কিছু এলাকার ছাত্রী সাধারণ বিভাগে পড়ালেখা করে সকালের মধ্যে আবার চলে যায় নিজ বাড়িতে’।

আগামী এক বছরের মধ্যে এখানে পথশিশু, বধির, পঙ্গুসহ আরো বেশকিছু প্রতিবন্ধী বিভাগ এবং বৃদ্ধাশ্রম ও হাসপাতাল করার মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিচালক হেলাল উদ্দিন বিন জমির উদ্দিন তার আত্মীয় কাউখালীর বাসিন্দা হাজি রাজা মিয়া কোম্পানির দানে ৭ কানির ভূমিতে ‘আল মানাহিল একাডেমিটি (অনাথ, এতিম ও দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষায়িত) গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠার প্রায় দুইবছর ছিল এতিমখানা, দরিদ্রদের পড়ালেখাসহ অন্যান্য বিভাগ। কোভিট শুরু হওয়ার আগে ২০২০ সালে এখানে অন্ধশিক্ষা বিভাগ চালু হয়। চট্টগ্রাম, ঢাকা, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার, বরিশাল, রাউজানসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অন্ধ শিশু-কিশোরদের এখানে এনে ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

মাদ্রাসার বর্তমান পরিচালক হেলাল উদ্দিন বিন জমির উদ্দিন বলেন, ‘কওমী সিলেবাস এবং সরকারি সিলেবাসের সমন্বয়ে, কম্পিউটার শিক্ষাসহ সমন্বিত শিক্ষা দেয়া হবে এখানে। আগামী বছর এখানে ইসলামী অর্থনীতি ও ইসলামী দাওয়া ফ্যাকাল্টি করা হবে। ভবিষ্যতে এটি হবে দেশ সেরা একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’। তিনি বলেন, ‘আল-মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানে অন্ধ এবং এতিম শিক্ষার্থীদের সকল ব্যয়ভার বহন করা হয়’।

প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মো. হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘৫০ জন অন্ধ শিক্ষার্থীর জন্য ৪জন (বর্তমানে আছে ৩জন) শিক্ষক রয়েছেন। এরমধ্যে ২ জন শিক্ষক অন্ধ ও একজন দৃষ্টিসম্পন্ন । তাদের দেখাশোনায় আছেন একজন খাদেম। অন্ধ বিভাগ চালুর পর কোন কোন অন্ধকে তাদের মা-বাবা, আবার অনেককে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন উপজেলার মাদ্রাসা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে এখানে এনে বিশেষ পদ্ধতিতে পড়ালেখা করাচ্ছে। ভবিষ্যতে সারাদেশে যত প্রতিবন্ধী আছে, তাদের সবাই যদি এখানে এসে পড়ালেখা করতে আগ্রহ দেখায়, তাদের প্রত্যককে এখানে স্থান করে দেয়া হবে। এ জন্য এখানে বড় বড় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং আরো নির্মাণ করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে, সমাজের বঞ্চিত প্রতিবন্ধীদের সকল সুযোগ সুবিধা দিয়ে বিনামূল্যে সকল বিষয়ে পাঠদান করে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষাগ্রহণ করে যাতে তারা মসজিদ, মাদ্রাসা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে নিজেদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সমাজে অন্ধ-প্রতিবন্ধীরাও যে অন্য দশজনের মতো মানুষ, তারা কারো বোঝা নয়, সেই হিসেবে তাদের গড়ে তোলার প্রয়াস চলছে এখানে’।

মাওলানা নাছির উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কেউ সূরা, কেউ কায়দা, আমপারা, কেউ হেফজ, কেউ বাংলা, ইংরেজি, অংকসহ বিভিন্ন বিভাগে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ে। বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ কলম ব্যবহার করে আলাদা আর্ট পেপারে তারা লিখতেও পারে। অন্ধ হলেও তাদের প্রতিভা খুবই প্রখর। তারা মোবাইলে নম্বর টিপে কল দিতে পারে অন্যকে। কেউ একবার তাদের দেখতে এলে পুনরায় সেখানে গেলে তা বুঝতে পারে।

তাদের কেউ কেউ এতই প্রতিভাধর যে, তারা নাত, ক্বেরাত, গজল পরিবেশন করে খুব শাণিত কন্ঠে।’ সরেজমিনে পরিদর্শনে কথা হয় অন্ধ বিভাগের শিক্ষক মাস্টার রবিউল হোসেনের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি রাজশাহী। তিনি ১২ বছরে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চোখ হারান। ঢাকা থেকে গ্রাজুয়েশন করা রবিউল বাংলা, অংক, ইংরেজি পড়ান ব্রেইল পদ্ধতিতে। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও অন্ধ। গত ৯ মাস ধরে আমি এখানে পড়াই। আমার মতো যারা আছে, তাদের পড়াতে আমার স্বাচ্ছন্দ লাগে। কোন সমস্যা হয় না। কোথাও যেতে চাইলে খাদেম সাহায্য করে’।

কক্সবাজারের বাসিন্দা হাফেজ শিক্ষক তামজিদুল হক জন্মগতভাবেই অন্ধ। তিনি এখানে ৮ মাস ধরে পাঠদান করান ব্রেইল পদ্ধতিতে। তিনি বলেন, ‘যেটা শিখেছি, সেটা অন্যদের শেখানো আমাদের দায়িত্ব। চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া, পাঠদানে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। দেড়বছর ধরে এখানে পড়ালেখা করে ঠাকুরগাঁও’র অন্ধ সাহেদ আলী, নীলফামারীর মোরশেদ। আরো আছে অন্ধ খাইরুল ইসলাম, তুহিন মোল্লা, সরোয়ার, মারুফসহ অনেকে। এসব অন্ধ ছাত্ররা বলেন, ‘উন্নতমানের খাবার, সাবান, পোশাক, ওষুধসহ সকল ভরনপোষণ দিয়ে আমাদের ব্রেইল পদ্ধতিতে জ্ঞান দিয়ে যোগ্য মানুষ করার চেষ্টা করছেন এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যারা আছেন, তারা।

জানা যায়, অন্ধ এসব শিক্ষার্থীর পড়ালেখা, ঘুমানো সবই অন্য দশজন থেকে একটু ব্যতিক্রম। তারা ভোরে ফজরের আজান দিলে ঘুম থেকে উঠে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পড়ালেখা করে। আবার ঘুম গিয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উঠে গোসল, নামাজ, খাবারশেষে দুপুরে শুরু করে পুনরায় পাঠদান। চলে রাত পর্যন্ত।

প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ভাইস প্রিন্সিপাল ফরিদ উদ্দিন বিন জমির উদ্দিন বলেন, ‘২২ সালের মধ্যে এখানে পথশিশু, বোবা, পঙ্গুসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীদের পড়ালেখার বিভাগ চালু করতে চাই। অন্ধ শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক বাড়াতে চাই। এই কমপ্লেক্সে এলাকার দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল আগামী এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে চালু করা হবে। এখানে একটি বৃদ্ধাশ্রমও করার পরিকল্পনা নিয়েছি। সমাজের ভিত্তবানরা সহযোগিতা করলে এ প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে আরো ভালো কাজ করতে সক্ষম হবে’।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট