
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। দেশের লাইফলাইনখ্যাত চট্টগ্রাম নগরীতে হাতের ইশারায় চলে যানবাহন। যানজট লেগে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও নগরীতে কোন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি। মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা ছাড়াই বিভিন্ন সময়ে শুধুমাত্র সিগন্যাল বাতির পেছনে খরচ হয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা। নগরীর সড়কগুলোতে নেই কোন ট্রাফিক সাইন, পথচারী পারাপারে নেই জেব্রা ক্রসিং। ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে ফুটওভার ব্রিজ, নেই আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। আর তা অপারেটের দায়িত্বে রয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। তবে টেকসই আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে যে অর্থের প্রয়োজন তা নেই কর্পোরেশনের। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কিছু সিগন্যাল বাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নগর উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সেবামূলক সংস্থার সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে ২০১২ সালে ২১টি মোড়ের সিগন্যাল বাতি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। বাকি ২৫টি মোড়ের বাতির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। সে সময় খরচ হয় দেড় কোটি টাকা। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে সিগন্যাল বাতির পেছনে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
এনালগ সিগন্যাল সিস্টেম: ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী স্বপন কুমার পালিতের নেতৃত্বে নগরীর বিভিন্ন জংশনে ট্রাফিক সার্ভের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করা হয়। গবেষণা দলের সদস্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীম জানান, গবেষণা কার্যক্রমের মূল বিষয়বস্তু ছিল নগরীর জংশনগুলোর সক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা যাচাই করা এবং গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি আধুনিক ‘ডিজিটাল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রণয়ন। সেই আলোকে শহরের গুরুত্বপূর্ণ ৫৩টি জংশন সার্ভে করে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।
মোড়গুলো হলো- বিমানবন্দরের প্রবেশমুখ, রুবি সিমেন্ট মোড়, সিমেন্ট ক্রসিং, নেভি হসপিটাল গেট, কাটগড়, ইপিজেড, সল্টগোলা, কাস্টমস, নিমতলা, বারেক বিল্ডিং, বাদামতল, চৌমুহনী, দেওয়ানহাট, টাইগারপাস, লালখানবাজার, ওয়াসা, জিইসি, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, সিএন্ডবি, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, অক্সিজেন, শেরশাহ, টেক্সটাইল, রাজাখালী, কালামিঞা বাজার, রাহাত্তারপুল, পাঁচলাইশ, গোলপাহাড়, প্রবর্তক, অলি খাঁ, গুলজার, গনি বেকারি, জামালখান, চেরাগী, কাজীর দেউড়ি, বৌদ্ধ মন্দির, আন্দরকিল্লা, সিনেমা প্যালেস, লালদিঘি, কোতোয়ালী, নিউমার্কেট, কদমতলী, আটমার্স, ঈদগাঁ, একে খান, অলংকার, সাগরিকা, নয়াবাজার, বড়পোল ও বেপারী পাড়া।
আট সমস্যায় যানজট:
নগর পরিকল্পনার অভাব: জনসংখ্যার চাপে নগরী দিন দিন বিস্তৃত হলেও সমন্বিত নগর পরিকল্পনার অভাবে সড়ক নেটওয়ার্ক সময়োপযোগী হয়নি। বহুতল ভবন, শপিংমল, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে; কিন্তু পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের জায়গা তৈরি হয়নি। রাস্তার পাশেই গাড়ি দাঁড় করানো হয় এবং যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
নগরীর প্রধান সড়কগুলো যেমন- আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাট, দুই নম্বর গেট, চকবাজার, টাইগারপাস এলাকায় সড়কের প্রশস্ততা তুলনামূলক কম। যানবাহনের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, অথচ নতুন বিকল্প সড়ক তৈরি হয়নি। ফ্লাইওভার নির্মাণ হলেও তা যানজট নিরসনে যথাযথ সমাধান দিতে পারেনি; বরং অনেক স্থানে নতুন করে জট তৈরি করেছে।
অবৈধ পার্কিং ও ফুটপাত দখল: যানজটের বড় কারণ হলো অবৈধ পার্কিং। ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে মূল সড়কে হাঁটে, ফলে গাড়ির গতি ধীর হয়ে যায়। মাঝে মাঝে অভিযান চালানো হলেও তা নিয়মিত ও টেকসই নয়।
গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা: নগরীর বাস ও মিনিবাসগুলোতে শৃঙ্খলা নেই। যাত্রী ওঠানামার নির্দিষ্ট স্টপেজ মানা হয় না। যেখানে খুশি গাড়ি থামানো হয়, হেলপাররা যাত্রী ডাকাডাকি করে সময় নষ্ট করেন। আবার অনেক চালক প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালায়, ফলে দুর্ঘটনা ও জট দুটোই বাড়ে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা: ট্রাফিক পুলিশের সংকট এবং আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকায় যান চলাচল সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সিগন্যাল বাতি থাকলেও সেগুলো অকার্যকর বা ভেঙে গেছে। আবার অনেক চালক নিয়ম ভেঙে উল্টোপথে প্রবেশ করে, যা জটকে আরও জটিল করে তোলে।
পণ্যবাহী যান চলাচল: চট্টগ্রাম বন্দর, শিল্পাঞ্চল এবং কন্টেইনার ডিপোতে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরির চলাচল হয়। নির্দিষ্ট সময় মেনে গাড়িগুলোর প্রবেশ ও প্রস্থান হয় না। ফলে দিনের বেলা পণ্যবাহী যানবাহন শহরের সড়কে ঢুকে যানজট আরও বাড়িয়ে দেয়।
রিকশা ও সিএনজি ট্যাক্সির আধিপত্য: নগরীর সড়কে বিপুলসংখ্যক রিকশা ও সিএনজি ট্যাক্সি চলাচল করে। এদের অনেকেই ট্রাফিক নিয়ম মানে না। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে থেমে যাত্রী ওঠানামা করানো বা ইউটার্ন নেওয়ার কারণে যানবাহনের গতি ব্যাহত হয়।
প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতি: ট্রাফিক আইন প্রয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতিও একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় প্রভাবশালী গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আবার চালকেরা জরিমানা এড়াতে ঘুষ দিয়ে পার পেয়ে যান। এতে করে আইন ভঙ্গকারীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে।
পূর্বকোণ/ইবনুর