দুপুর গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা আড়াইটা। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর। আর এই খবরেই উল্লাসে ফেটে পড়েন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। মুহূর্তেই বাসা-বাড়ি থেকে বের হয়ে হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে মানুষ। পতাকা হাতে খ- খ- মিছিল নিয়ে বিজয় উল্লাস করতে রাস্তায় নামেন লাখো মানুষ। নগরীর সব পথে নামে জনতার ঢল। যারা এসেছিলেন, সবাই ফেটে পড়েন উচ্ছ্বাসে। এমন উল্লাস চলে রাত অবধি। বিজয় উল্লাসের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বন্দর নগরী। স্লোগানের পাশাপাশি মিষ্টি বিতরণ করতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল বিকেলে নগরীর নিউমার্কেট মোড়ে জড়ো হন কয়েক হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে শিশু থেকে শুরু করে ছিলেন নানা বয়সী নারী-পুরুষ। অথচ ঠিক একদিন আগেই একই স্থানের চিত্র ছিল অন্যরকম। যেখানে পুলিশ আর আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা গুলি আর টিয়ারশেল মেরে সরিয়ে দিয়েছিলেন ছাত্র-জনতাকে। সেই স্থানটিতেই গতকাল বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেন ছাত্র-জনতা। বিজয় স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় চারপাশ। নিউমার্কেট মোড়ের ভাস্কর্যের ওপর দাঁড়িয়ে বিজয় পতাকা উড়াতে দেখা যায় তরুণ-যুবকদের।
বিজয় উল্লাসে যোগ দেওয়া কলেজ পড়–য়া ইয়াসমিন তামান্না বলেন, এই নিউমার্কেটেই আমাদের ভাইবোনদের গুলি চালানো হয়। তাই বিজয়ের এ দিনে এখানে এসে মনে হচ্ছে দেশ আবার স্বাধীন হয়েছে। এ বিজয় নির্যাতিত ছাত্র জনতার।
নগরীর কাজীর দেউড়ি মোড়ে হাজারো মানুষের ভিড়ে মাকে জড়িয়ে কাঁদতে দেখা যায় ৩০ বছরের যুবক মোহাম্মদ আলবিকে। বারবার মা তার সন্তানের চোখের পানি মুছে দিচ্ছেন। কিন্তু কান্না কোনভাবেই থামছিলই না। কান্নারত অবস্থায় আলভি বলেন, ‘আমি কাঁদছি সেই সব বীরদের জন্য, যাদের প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা নতুন করে বিজয় পেলাম। কিন্তু তারা তো সেটি দেখে যেতে পারলেন না। আমরা তো ভয়ে সেভাবে কিছুই করতে পারলাম না। তারাই সব করলেন, আজ কিনা তারাই নেই এই বিজয় মিছিলে।’
লাখো জনতার ‘স্বাধীন, স্বাধীন’ স্লোগানে প্রকম্পিত শহরের রাজপথ। আনন্দ মিছিলে শামিল হন নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরেরাও। বিজয় উল্লাসের কারণে কোথাও কোন ধরনের গণপরিবহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। পুরো নগরজুড়ে লাখ লাখ মানুষ পায়ে হেঁটে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করছে। এছাড়া শেখ হাসিনা পদত্যাগের খবরে শত শত তরুণ-তরুণী শহরে বিভিন্ন জায়গা থেকে রিকশা ও ইজিবাইকে জড়ো হতে দেখা যায় নগরীর বিভিন্ন স্থানে। তাঁদের হাতে ও মাথায় পতাকা। তারা স্লোগান দিতে থাকে, কে পালিয়েছে, কে পালিয়েছে, শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনা। অনেকেই স্লোগান দেন জিতিলো রে, জিতিলো, ছাত্র সমাজ জিতিলো।
নগরীর শাহ আমানত সেতু (নতুন ব্রিজ) থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত প্রতি মোড়ে মোড়ে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নারী-শিশুসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অবস্থার দেখা যায়। সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শাহ আমানত সংযোগ সড়কের রাজাখালী আর্মি ক্যাম্পের সামনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের জড়িয়ে ধরে জনতাকে উল্লাস করতে দেখা গেছে।
শাহ আনানত সেতু এলাকায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল, রিকশা, ইজিবাইক ও মিনি ট্রাকে চড়ে মানুষকে রাজপথ প্রদক্ষিণ করতে দেখা যায়। কারও হাতে জাতীয় পতাকা, কেউ লাঠির মাথায় লাল কাপড় বেঁধে শূন্যে উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন। এ সময় তাদের শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে শোনা গেছে।
নগরীর অক্সিজেন মোড়, ২ নং গেট মোড়, আতুরার ডিপো, বায়েজিদ বোস্তামী, মুরাদপুর এলাকায় রাস্তায় নেমে এসে বিজয়োল্লাসে মাতে সর্বস্তরের জনতা। এসব এলাকার বিভিন্ন অলিগলি থেকে মিছিল নিয়ে মূল সড়কে নেমে আসে সাধারণ মানুষ। বিজয়োল্লাসে শামিল হয় শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শ্রমিক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষ।
এদিন দুপুরের পর আশপাশের এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে অক্সিজেন মোড়ে জড়ো হয় সাধারণ মানুষ। এসময় নানা স্লোগানের পাশাপাশি মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা যায় তাদের। একই সময়ে আশেপাশের এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে জড়ো হওয়া জনতার ঢলে জনসমুদ্রে পরিণত হয় ২ নং গেট এলাকা। এসময় জাতীয় পতাকা উড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে উল্লাসে মাতে জনতা। বায়েজিদের দিকে রেললাইন, মুরাদপুরের দিকে বিমান অফিস, প্রবর্তকের দিকে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং জিইসি মোড়ের দিকে সুন্দরবন কুরিয়ার এলাকা পর্র্যন্ত আচড়ে পড়ে জনতার ঢেউ। এসময় আশেপাশের সবকটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকলেও নির্বিঘেœ চলাচল করেছে এম্বুলেন্স।