১৫ আগস্ট বাঙালি জাতীয় জীবনের এক অন্ধকার দিন, কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। এদিন আমি নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের ৬ নম্বর ব্লকে ২৬নং কক্ষে ছিলাম। আগের দিন রাত্রে বিদেশি একটি জার্নাল পড়ায় আমার ঘুমাতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। সকাল ৮টায় টেলিফোনটি বেজে উঠলে ধরতেই ওপাশ থেকে শুনি জানে আলম দোভাষের কান্নাজড়িত কণ্ঠ। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুকে ওরা মেরে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধু আর নেই। কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু বাংলাদেশ আছে। আমার মাথার ওপর এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার দাবি করুন। তিনি আমাদের বললেন, তোমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাও। নইলে আমার বিপদ হবে। আমরা বেরিয়ে আসলাম।
পরদিন আমি চট্টগ্রাম চলে আসি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এ দীর্ঘ পথ আসার পথে যাদেরই দেখলাম সবারই মুখ বিমর্ষ, গম্ভীর। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো কটুবাক্য আমার কর্ণগোচর হয়নি। এ সময় আমার চোখে বার বার ভেসে আসছিল কক্সবাজারে আমাদের হোটেল সাইমনে বঙ্গবন্ধুর সৌজন্যে দেয়া ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের কথা। তখন ১৯৬৮ সাল। পাশে বসে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনে ৩২ নম্বরে জানে আলম দোভাষকে সঙ্গে নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করি। উদ্দেশ্য শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনাটি বঙ্গবন্ধুকে অবগত করা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের পর আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া এদেশ কখনও স্বাধীন হবে না বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে সেটিই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। মীরসরাই উপজেলার শুভপুর ব্রিজটি ছিল সে সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এটি উড়িয়ে দিতে পারলেই পাকিস্তানি সৈন্যরা আর সহজে চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে পারবে না। আমি বঙ্গবন্ধুকে আমার এ কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম যেন পুরো আকাশটি ভেঙে পড়লো। যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁকে কেউ হত্যা করবে এটি কোনক্রমেই মেনে নিতে পারছিলাম না, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হলো বাংলাদেশ যেন এতিম হয়ে গেল। আর কোনো কিছু না ভেবেই দৌড়ে প্রফেসর খালেদ সাহেবের রুমে গেলাম। তিনিও নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলে ছিলেন । দেখি রেডিওতে তিনি খবর শুনছেন । মেজর ডালিম তখন রেডিওতে বক্তব্য দিচ্ছিল। আমি বাচ্ছা ছেলের মত মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্না শুরু করে দিলাম। খালেদ সাহেব আমাকে শান্ত হতে বললেন। কিছুক্ষণ পর আমি খালেদ সাহেবের কক্ষ থেকে বের হয়ে হেঁটে ফার্মগেট আসলাম। পুরো শহর একেবারে নিস্তব্ধ। সবার চোখে-মুখে কী যেন হারানোর ছাপ। এখান থেকে রিকশা করে ধানমণ্ডিতে কায়সারের বাসায় গেলাম। কায়সারও দেখি ভীষণ মুষড়ে পড়েছে। তখন সম্ভবত, সকাল সাড়ে নয়টা।
এদিকে খুনি মোস্তাকের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। আমাদের পটিয়ার নুরুল ইসলাম চৌধুরীও মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। আমি আর কায়সার নুরুল ইসলাম চৌধুরীর বাসায় গেলাম, তিনি আমাদের দেখে থ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলেন এ অবস্থায় তোমরা কেন এখানে এসেছো ? আমরা বললাম আপনি কেমন করে মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন? কেমনে পারলেন এ কাজ করতে? কই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এঁরাতো যোগ দেননি। কিন্তু আপনি কেন যোগ দিলেন? আমি কাঁদতে কাঁদতে উনার পায়ে লুটিয়ে পড়ি, আর বলি আপনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করুন
আমার আপ্যায়ন করার সুযোগ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু উঠেছিলেন মোটেল উপলে। ডিনার শেষ করে আমরা সবাই উপলে গেলাম। তিনি উপস্থিত নেতৃবৃন্দের সাথে রাজনীতির সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলেন। তিনি খাটে সোয়া আর আমরা সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাঁর কথাগুলো শুনছিলাম। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি নুর আহম্মদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এই নুর আহম্মদ তুই মৌলভী ফরিদকে পরাজিত করতে পারবি?” মৌলভী ফরিদ ছিলেন সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের বেস্ট পার্লামেন্টারিয়ান। বঙ্গবন্ধুর এ কথার উত্তরে নুর আহম্মদ বললেন, আপনি দোয়া করলে পারবো। তখন উপস্থিত সবার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বললেন, “তোরা আমাকে ১৫১টি সিট আইন্যা দে, আমি দেখাইয়া দিমু।”
‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেল, আর বঙ্গবন্ধুও আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে ঠিকই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ভাবতেই পারছিলাম না, এমন বিশাল হৃদয়ের এ মানুষটিকে কেমনে হত্যা করতে পারলো ঘাতকরা। এক এক করে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার বিভিন্ন স্মৃতি ভেসে উঠছিলো মানসপটে। ১৯৭১ এর ১৭ মার্চ পরিকল্পনার কথা জানাতেই তিনি আমার বুকের ওপর হাত রেখে বললেন, “সাবাস, যাও তুমি এক্সক্লুসিভ জোগাড় কর, এক্সক্লুসিভ জোগাড় করে অর্ধেক ঢাকায় রেখে যাবি, আর অর্ধেক দিয়ে শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিবি।” চোখের পানি থামাতে পারছিলাম কোনক্রমেই। রুমাল দিয়ে বার- ংবার চোখ মুছছিলাম। চট্টগ্রাম এসে পরদিন বাসায় বঙ্গবন্ধুর জন্য মিলাদের আয়োজন করি।” জিয়াউর রহমান যখন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক তখনকার একটি ঘটনা। একদিন চট্টগ্রামের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার আমাকে জানালেন যে, জিয়াউর রহমান সাহেব আসবেন এবং জেলা পরিষদ মিলনায়তনে সাবেক এমপি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে মতবিনিময় করবেন। আমি যেন উপস্থিত থাকি। আগের দিন রাতে প্রফেসর খালেদ সাহেব, হারুন ভাই এঁদের সাথে কথা হলো। সিদ্ধান্ত হলো যাবার। পরের দিন যথারীতি আমরা উপস্থিত হলাম। জিয়াউর রহমান তার সূচনা বক্তব্যে বলেছিলেন, “যারা বক্তব্য রাখবেন তারা যেন কোন প্রকার সংকোচবোধ না করে খোলা মনে বক্তব্য রাখেন।” এক পর্যায়ে সাবেক এমপিদের পক্ষ থেকে আমাকে বক্তব্য রাখতে বলা হলো। আমি বক্তব্যের শুরুতেই মেজর জিয়ার উদ্দেশে বললাম, যুদ্ধকালে আমি আর আপনি একসাথে ছিলাম। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমরা ঠিক করেছিলাম, চট্টগ্রামের ১০ জন রাজাকারকে হত্যা করতে হবে। আমরা অস্ত্র দিয়ে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি টিমও পাঠিয়েছিলাম ভিতরে। ওরা কয়েকজনকে হত্যা করতে পারলেও বেশিরভাগই বেঁচে যায়। সেদিন বেঁচে যাওয়া রাজাকারদের ৫ জন আজ সামনের সারিতে বসা। যারা তাদের বক্তব্যে আপনাকে মাওসেতুং হতে এবং তার মত লাল বই লিখতে বললো। তারা এখন এদেশকে পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখছে। এ দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধাও বেঁচে থাকতে তাদের এ স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে না। আমি বললাম সবার আগে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে হবে। আমার বক্তব্যের পর হলের অধিকাংশ মানুষ হাত তালি দিয়ে আমার বক্তব্যকে সমর্থন জানায় এবং হলের বাইরে যারা ছিলেন তারা সবাই জয় বাংলা স্লোগান দিতে থাকে। আবার অনেকেই বললেন, কি বলে মোশাররফ সাহেব এসব! মোশাররফ সাহেবের আজ রেহাই নেই। তাকে আজ রাতেই লালদিঘি যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালি জাতির বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র ও সফল গণ-বিপ্লবের অনন্য মহানায়ক। জাতীয় দাবি ছয় দফা উত্থাপন এবং সেই দাবিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও উদীপ্ত করতে তাকে আগরতলার মামলার আসামি হয়ে ফাঁসি কাষ্ঠে মুখোমুখি হতে হয়। অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন জীবনের মূল্যবান সময়। তবু পিছু হটেননি ক্ষণিকের জন্যও। তাঁর প্রচণ্ড আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের কারণে তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়ে ওঠেন। যার ফলে তাঁর হাত ধরেই আসে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। এ মানুষটি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তাঁর সুদৃঢ় নেতৃত্বের কারণে একটি স্বল্পোত দেশে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে আসলে দেশের রাজনীতির চিত্র পুরো পাল্টে যায়। জনগণের ভালোবাসায় শক্তি সঞ্চয় করে বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঠাঁই করে নেয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে ধারাবাহিক উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে তিনি আজ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত অধিকাংশকেই বিচারের মুখো- মুখি করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর দেয়া দেশ তাঁরই কন্যার হাত ধরে আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষের হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
পূর্বকোণ/পিআর