চট্টগ্রাম বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

কর্ণফুলীতে দূষণে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৯ জুলাই, ২০২৩ | ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

৭৯ স্থানে কর্ণফুলী নদী দূষণের চিত্র দেখেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এরমধ্যে ৭৭ স্থানে রয়েছে ভয়াবহ দূষণ। শিল্প, পয়োঃবর্জ্য, পলিথিনসহ রাসায়নিক-কঠিন ও তরল বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। দূষণে ঝুঁকিতে রয়েছে জীববৈচিত্র্য। নদী কমিশনের সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

 

সমীক্ষাটি বলছে, ৭৭ স্থানের মধ্যে নগরীর ২৩ স্থানে দূষণ রয়েছে। ১৯টি খালের মাধ্যমে গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানা, ডায়িং মিলের তরল ও কঠিন বর্জ্য সরাসরি পড়ছে কর্ণফুলীতে। এছাড়াও জেলার রাঙ্গুনীয়া, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী উপজেলায় ব্যাপক দূষণ রয়েছে। পরিবেশ আইন প্রয়োগে নদী দূষণ বন্ধ করার সুপারিশ করেছেন সমীক্ষাদলের সদস্যরা।

 

সমীক্ষাটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নগরীর শিল্পজোন এলাকা ও জেলার কর্ণফুলী উপজেলায় নদী ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে। কর্ণফুলী উপজেলায় দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা থেকে মারাত্মক দূষণ ছড়াচ্ছে। সিমেন্ট, চিনি উৎপাদনকারী শিল্প, ফিশিং কমপ্লেক্স, তেল পরিশোধন কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। এছাড়াও সিটি করপোরেশন এলাকায় গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানা, ডায়িং কারখানার বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদীতে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে গড়ে উঠা তেলের দোকান, খোলা টয়লেট, সার কারখানা, সিমেন্ট কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকার শিল্প-প্রতিষ্ঠানের কেমিক্যাল বর্জ্য ড্রেন ও খালের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে নদীতে। এছাড়াও কৃষি কাজে ব্যবহৃত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার খালের মাধ্যমে নদীতে মিশছে। দূষণের কারণে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

 

পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য :

জেলার রাউজান উপজেলা থেকে সিটি করপোরেশন এবং নদী তীরবর্তী বিভিন্ন উপজেলা হয়ে মোহনা পর্যন্ত পলিথিন বা প্লাস্টিকজাতীয় পণ্যের ব্যাপক দূষণের শিকার কর্ণফুলী। নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর জমা হয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যা নদীর মাছ, জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিসাধন করছে। কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং করতে গিয়ে পলিথিনের স্তর নিয়ে বড় সমস্যায় পড়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তিন স্তরে ২-৩ মিটার পলিথিন ও প্লাস্টিকের স্তর জমেছে নদীর তলদেশে। ফলে ৩১ ইঞ্চি ব্যাসের ড্রেজার দিনে ১০-১২ ঘণ্টার বেশি খনন কাজ চালাতে হিমশিম খেতে হয়েছে।

 

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের উপকূলীয় নদ-নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। যা ৩৯ শতাংশ। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর তলদেশের মাটি, পানি, মাছ ও উদ্ভিদের ক্ষতি ছাড়াও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

 

সরেজমিনে শাহ আমানত সেতু, চাক্তাই ও রাজাখালী খাল এলাকা ঘুরে দেখা যায় নদীর তীর ও তলদেশে পথিলিন এবং প্লাস্টিকজাতীয় পণ্যের স্তর পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে পলিথিনের স্তরের জন্য নদীর কিনারা ও তলদেশের মাটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কয়েকটি স্থানে পলিথিন বর্জ্য জমাট হয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। চাক্তাই ও রাজাখালী খাল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে কালো ও বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি।

 

ওয়াসার উদ্বৃতি দিয়ে সমীক্ষাটি বলছে, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন সাড়ে তিন কোটি লিটার স্যুয়ারেজ বর্জ্য তৈরি হয়। এর বেশিরভাগ পড়ছে নদীতে। এর সঙ্গে রয়েছে শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য।

 

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিদিন চট্টগ্রাম নগরী থেকে নানাভাবে প্রায় আড়াই শ মেট্রিক টন পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। এসব বর্জ্য মাছসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এতে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের রোগ।

 

পরিবেশ অধিদপ্তর সমীক্ষা :

২০১৬ সালে কর্ণফুলীর দখল-দূষণ নিয়ে জরিপ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। তাতে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীতে মিঠা পানির ৬৬ প্রজাতির এবং মিশ্র পানির ৫৯ প্রজাতির ও সামুদ্রিক ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। মিঠা পানির ২০-২৫ প্রজাতির ও মিশ্র পানির ১০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। ১০-২০ প্রজাতির মাছ ছাড়া অন্য প্রজাতির মাছ বিপদাপন্ন। এখনও মাঝে মাঝে কর্ণফুলী নদীতে ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়। নদীর পাড়ে এবং আশেপাশে গড়ে উঠা ৩০০-৪০০ টি ছোট-বড় কল-কারখানার বর্জ্যসহ নগরীর কঠিন বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ফেলার কারণে কর্ণফুলীর বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি নদীর পরিবেশও হুমকির মুখে পড়েছে। ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্প না থাকায় নগরবাসীর সৃষ্ট ও গৃহস্থালি এবং পয়ঃবর্জ্যসহ প্রায় ১৫-২০ কোটি লিটার বর্জ্য নদীতে পতিত হচ্ছে।

 

জীববৈচিত্র্য :

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষা বলছে, কর্ণফুলী নদীতে এক সময়ে বেলে, কাঁচকি, চান্দা, পুঁটি, বাচা, চেলা, পাওয়া যেত। আইড়, কালিবাউস, কাতল, রুই, মৃগেল, বোয়াল, ফলই, পাঙ্গাস, নাইলোটিকা, গলদা, চিংড়ি, ছোট হরিণা চিংড়ি মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। ২০ বছর আগে বাবমি, চিতল, কাঁচকুড়ি, পারশে ও বাঁশপাতা মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর পাওয়া যায় না। নির্বিচারে মৎস্য আহরণ, কারেন্ট জাল, ছোট ফাঁস জালের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং দূষণের কারণে মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ কমে যাচ্ছে। নদীতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের স্বীকৃত স্থান বা মৎস্য অভয়াশ্রম না থাকায় অনেক মাছ প্রজননের অভাবে হারিয়ে গেছে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে।

 

নদী রক্ষা কমিশন বলছে, কর্ণফুলীতে ৩৩ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেছে। এছাড়াও নদীতে শামুক, কাঁকড়া ও ঝিনুক পাওয়া যায়। চিল, সাদা বক, মাছরাঙা, ভুবন চিল, গাঙ্গচিল, পানকৌড়ি দেখা যায়। মাছসহ জলজপ্রাণী দিন দিন কমে যাচ্ছে। সরপুটি, ঘাউরা, রিঠা, বাঘাআইড়, বাঁশপাতা, ফ্যাসা, অলুয়া, চাকা মাছ ও রোশনাই চিংড়ি-কাঠালি চিংড়ি বর্তমানে বিরল। কিন্তু দুই দশক আগেও এসব মাছ সচরাচর পাওয়া যেত। এতে মৎস্যজীবী ও জেলে সম্প্রদায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

 

নদীতে মাছসহ জলজপ্রাণীর উপস্থিতি ও বৈচিত্র্য এবং ইকো সিস্টেম দুই দশকে অনেক কমেছে। পলি জমে ও দূষিত বর্জ্যরে কারণে নদী ভরাট হয়ে গভীরতা কমে গেছে। মাছ ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ও প্রজননকেন্দ্র কমে যাচ্ছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীতে লবণাক্ততা বাড়ছে। দূষণের কারণে নদীর পানি গৃহস্থালি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

 

সমীক্ষাটি বলছে, কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে চারটি নদী, ১৩৮টি সংযুক্ত খাল, বিল, ছড়া ও লেকের সংযোগ রয়েছে। এসব সংযোগ মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মাছ ও জলজ প্রাণী নদী থেকে খাল-বিল ও লেকে বিচরণ করে। বংশবৃদ্ধি ও উৎপাদনসহ নানা ধরনের উন্নয়ন সাধনে সহায়ক হয়।

 

সরেজিমন :

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বোয়ালখালীর কালুরঘাটে দুটি পেপার মিলের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম পাড়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের কঠিন বর্জ্য সরাসরি পড়ছে নদীতে। পশ্চিম গোমদণ্ডী ও শাকপুরা এলাকার দুটি লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বর্জ্যও সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। কর্ণফুলী সংযোগ বোয়ালখালী খালের মিলিটারি পুল এলাকায় রয়েছে একাধিক লবণ ও কাগজ তৈরির কারখানা। রয়েছে গার্মেন্টস কারখানা। এসব কারখানার বর্জ্য খালের মাধ্যমে মিশছে নদীর পানিতে। পটিয়ার কোলাগাঁও ইউনিয়নের বোয়ালখালী খাল থেকে শিকলবাহা খাল পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটারে নির্মাণ করা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পুরোনো জাহাজ নির্মাণ কারখানাসহ অন্তত ১০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এসব কারখানার কঠিন ও রাসায়নিকমিশ্রিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কর্ণফুলীতে। নদী দূষণের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়, কর্ণফুলী উপজেলায়। এখানে নদীর তীর ও বিভিন্ন খালের পাড়ে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট কারখানা, জাহাজ নির্মাণ-জাহাজ মেরামত, বিদ্যুৎকেন্দ্র, তেল শোধনাগারসহ অনেক ভারী শিল্প। ভারী শিল্পের কঠিন বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদী। নগরীর পতেঙ্গা ও কালুরঘাট শিল্প অঞ্চলের বর্জ্য সরাসরি ও খালের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে নদীতে। এছাড়াও নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার বর্জ্য নালা-খালের মাধ্যমে মিশছে নদীর পানিতে।

 

পরামর্শ :

শিল্প-কারখানায় আধুনিকমানের ইটিপি স্থাপন করে কারখানার বর্জ্য পরিশোধন করে নিঃসরণ এবং ইটিপি সার্বক্ষণিক চালু রাখার পরামর্শ দিয়েছে নদী রক্ষা কমিশন। এছাড়াও পরিবেশ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) কঠোরভাবে প্রয়োগ করে জেল ও জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করে নদী ও জলাশয় দূষণ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে সরকারি এ সংস্থাটি।

পূর্বকোণ/মাহমুদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট