চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

যুবাদের নৈপুণ্যে বসন্ত এলো ক্রিকেটে ম্যাচসেরা

আকবর হুমায়ুন কবির কিরণ

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

যে সে সাফল্য নয় একেবারে বিশ্বকাপ জয়! হোক না সেটা অনূর্ধ্ব-১৯ দল, বিশ্বকাপ তো। সেই আনন্দেই শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমই নয়, নুতন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ যুবাদের সাফল্যে উদ্বেলিত পুরো জাতি। এই আনন্দ লাল সুবজের জার্সি গায়ে অভাবনীয় এক ইতিহাস সৃষ্টির। দীর্ঘ ৩৩ বছরেও যা পারেনি বাংলাদেশ। গতকাল তাই হলো। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ডিএল মেথডে ৩ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ঘরে তুললো আইসিসি বিশ্বকাপ শিরোপা। আকবর আলীদের এই শিরোপা দিয়েই বসন্ত এলো বাংলাদেশ ক্রিকেটে। এদেশের কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমী এমন আনন্দ উপলক্ষ’র অপেক্ষাতেই ছিলেন এতদিন। অভিনন্দন জুনিয়র টাইগারদের। একইসাথে অভিনন্দন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও দল পরিচালনায় থাকা সংশ্লিষ্ট সকলকে।
ভারত যখন ১৭৭ রান করল, তখন ম্যাচের হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষেই পাল্লা ভারী। পচেফস্ট্রুমের উইকেটে এমন কোনো জুজু ছিল না, তারপরও ফাইনাল মানেই তো চাপ। শুরুতে মনে হচ্ছিল সেই চাপ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে বাংলাদেশের যুবারা। তানজিম হাসান সাকিব আর পারভেজ হোসেন ইমন মিলে শুরুটা করেছিলেন দুর্দান্ত। প্রথম কয়েক ওভারে ৬ এর ওপর রান রেট ছিল বাংলাদেশের। ভারতের বোলাররা অনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ওয়াইড-নো দিয়ে কাজটা সহজ করে দিচ্ছিলেন। আর ইমন আর তামিম খেলছিলেন চোখজুড়ানো কিছু শট। এর মধ্যে লেগ স্পিনার রভি বিষ্ণয় এলেন, তাকে স্লগ সুইপে দারুণ একটা ছয়ও মারলেন তামিম। কিন্তু সেই কাজটা আবার করতে গিয়েই শুরু বাংলাদেশের হোঁচট খাওয়ার। ১৭ রান করে ফিরলেন তামিম। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল হাসান জয় দারুণ দুইটি চারে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিষ্ণয়ে বিস্মিত হওয়া শুরু হলো বাংলাদেশের। গুগলি বুঝতে না পেরে বোল্ড জয়, তৌহিদ হৃদয় আরেকটি গুগলি বুঝতে না এলবিডব্লু হলেন কোনো রান না করেই। ইমনও ক্র্যাম্প হয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছাড়লেন, মড়ার ওপর খাড়ার ঘা যোগ হলো বাংলাদেশের। কার্যত ৬২ রানে চারটি উইকেট হারিয়ে ফেলল বাংলাদেশ। খানিক পর শাহাদাত যখন স্টাম্পড হয়ে গেলেন বিষ্ণয়ের বলে, ৬৫ রানে আসলে পাঁচ উইকেট নেই বাংলাদেশের। ১৭৭ রান তখন মনে হচ্ছিল অনেক দূরের পথ। আকবর আলী শুরুতেই দারুণ কিছু শটে চাপ কমালেন। কিন্তু অন্য পাশে শামীম হোসেন শুরু থেকেই ছটফট করছিলেন। অস্থির হয়েই সুশান্তের অফ স্টাম্পের বাইরের বল তাড়া করতে গিয়ে একস্ট্রা কাভারে তুলে দিয়ে এলেন ক্যাচ। ৮৫ রানে ৫ উইকেট নেই বাংলাদেশের, অশনী সংকেত আরেকটু ভালো করে দেখা দিতে শুরু করেছে। অভিষেক ব্যাট করতে পারেন, একটা চার মেরে সেটার প্রমাণও দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেও ভর করল অস্থিরতার রোগ। এক ওভারে দুই বার জীবন পাওয়ার পরও সুশান্তের বলটা আবার পুল করতে গিয়ে দিয়ে এলেন ক্যাচ। ১০২ রানে ৬ উইকেট নেই বাংলাদেশের। ইমনকে চোট ভুলে আবার নামতে হলো মাঠে। আকবরের সঙ্গে মিলে ঠিক করলেন, উইকেট দেওয়া যাবে না। তখনও বিষ্ণয়ের ওভার চারেক বাকি, রানও দরকার ৭০ এর বেশি। এরপর আর কোনো স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান নেই। দুজন মিলে একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু চোটের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো ইমনকে, ৪৭ রান করে জইসওয়ালের বলে ক্যাচ দিয়ে এলেন। দুজনের ৪১ রানের জুটি ভাঙল, তখনও জয়ের জন্য দরকার ৩৪ রান। আকবর ঠিক করলেন, ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। জানতেন, একটা উইকেট হারালে ডিএলের সমীকরণও চলে যাবে বিপক্ষে। টানা তিন ওভারেরও বেশি কোনো রান না নিয়েই কাটিয়ে দিলেন দুজন। বিষ্ণয়কে এনেও লাভ হলো না। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দুজন। এরপর যখন বৃষ্টি শেষ পর্যন্ত এলো, জয় থেকে ১৫ রান দূরত্বে বাংলাদেশ। আর খেলা না হলে বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু বৃষ্টি ছিল মাত্র মিনিট দশেক, এরপর সমীকরণ দাঁড়াল পাঁচ ওভারে সাত রান। সেটা নিতে এক ওভারের বেশি নেয়নি বাংলাদেশ। তার আগের গল্পটা বাংলাদেশের বোলারদের। শুরু থেকেই শরিফুল আর সাকিব দারুণ বল করে চাপে রেখেছিলেন ভারতের ওপেনারদের। অভিষেকের বলে শেষ পর্যন্ত উইকেট দিয়ে এলেন সাক্সেনা, দুই রানেই ফিরলেন। তবে জইসওয়াল স্থির থেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন ইনিংস, তিলক ভার্মার সঙ্গে যোগ করলেন ৯৪ রান। সাকিবের বলে শেষ পর্যন্ত ভার্মা আউট হলেন, সেখানেও শরিফুল। দারুণ একটা ক্যাচ নিলেন, ১০৩ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারাল ভারত। প্রিয়াম গার্গ ৭ রান করে রাকিবুলের বলে আউট, তবে জুরেলকে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন জইসওয়াল। এর পরেই শরিফুল এসে করলেন গেম চেঞ্জিং ওভার। প্রথমে তার বলে ৮৮ রান করে ফিরলেন জইসওয়াল, পরের বলে ভির আউট কোনো রান না করেই। ১৫৬ রানে ৫ উকেট নেই ভারতের। সেই চাপ থেকে শেষ পর্যন্ত আর বেরুতেই পারল না তারা। ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়ে গেলেন জুরেল, পরের ওভারে সরাসরি থ্রোতে বিষ্ণয়কে ফেরালেন আবার সেই শরিফুল। এরপর অথর্ভ আর কার্তিককে ফিরিয়ে দিলেন অভিষেক, আর সুশান্তকে আউট করে শেষ টান দিলেন সাকিব। শেষ ক্যাচটাও ধরলেন শরিফুলই। ৩ উইকেটে ১৫৬ রান থেকে ১৭৭ রানে অলআউট হলো ভারত।
ম্যাচসেরা আকবর
প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। গতকাল আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতকে বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুলেছে বাংলাদেশের যুবারা। বাংলাদেশের জয়ে বড় অবদান রেখেছেন অধিনায়ক আকবর আলী। বিপদের মুহূর্তে দলের হাল ধরে ৪৩ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। যার ফলে ম্যান অব দ্য ফাইনালের পুরস্কারও উঠেছে তার হাতে। অন্যদিকে, টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন ভারতের যশওয়াল। এই বিশ্বকাপের সেরা রান সংগ্রহকারী ব্যাটসম্যান তিনি। ৬ ম্যাচে ১টি সেঞ্চুরি ও চারটি হাফ সেঞ্চুরিতে ৪০০ রান করেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন
উত্তেজনাকর, উন্মাদনাময় ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবার বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ে টাইগারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বার্তায় রাষ্ট্রপতি দলের সব খোলোয়াড়, কোচ, ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দিত করেছেন। ভবিষ্যতেও জয়ের এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। অপর এক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাপুটে এই জয়ের জন্য অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের সব সদস্য, কোচ, ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মুজিববর্ষের প্রাক্কালে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে জয়লাভ করায় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল, কোচ, ম্যানেজার এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে জানান, এই খেলোয়াড়ি মনোভাব ধরে রেখে এভাবেই ভবিষ্যতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
এদিকে যুব দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল। বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক সাফল্যের পরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক বলেন, ‘এ বিজয়ের অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আমার নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো খেলায় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হবে এটা আমাদের স্বপ্নেরও বাইরে ছিলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই বলতেন, আমরা একদিন ওয়ার্ল্ড কাপ ছনিয়ে আনবো, চ্যাম্পিয়ন হবো। তার কথার সুর ধরে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। যুব বিশ্বকাপ আমরা জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। আমারে খেলোয়াড়, দর্শক ও দেশের মানুষকে কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। বিশেষ করে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এ বিজয় আমি মনে করি বাংলাদেশের মানুষের বিজয়। বাঙালী জাতির বিজয়।’ তিনি দলের খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, কোচ ও বাংলাশে ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি আশা করছি, এই বিজয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট