চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

নারী দিবস ও নারীর পরিচয়

ফারিহা তাসনীম

৮ মার্চ, ২০২০ | ২:৪২ পূর্বাহ্ণ

৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি বেশ কিছু দেশে এই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ছুটির প্রচলন রয়েছে। নারী দিবস উদযাপন করার পাশাপাশি এই দিন উপলক্ষে সভা-সমাবেশ, অনুষ্ঠান করা, গান বানানো, লেখালেখি করা যতটা জরুরি ঠিক ততটাই জরুরি এই দিনের ইতিহাস সম্পর্কে জানা। এই দিনটির জন্মের পেছনে মূলত হাত রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ইতিহাসের। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা বারো থেকে আট ঘন্টায় নামিয়ে আনা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের সুতার কারখানার নারী শ্রমিকেরা রাজপথে নেমেছিলেন। তাদের উপর চলে সরকার বাহিনীর অত্যাচার। এরমধ্যে অনেক নারী শ্রমিক আটকও হন। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকরা কাজের সুস্থ কর্ম পরিবেশ, সময় ও যোগ্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সেই বছর প্রথমবার আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এরপরের বছর অর্থাৎ ১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখ জাতীয়ভাবে নারী দিবস পালন করেন। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন এবং এতে অংশ নেয় ১৭ টি দেশ থেকে আসা একশজন নারী প্রতিনিধি। এই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। নারী দিবস পালনের মূল দাবীটি হলো নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। অর্থাৎ, ঘরে-বাইরে, পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় কাজে, সামাজিক কাজে, ধর্মীয় আচরণবিধিসহ সব জায়গায় নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। নারী দিবস পালন নিয়ে একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো- “নারী দিবস পালন করে কেন নারীদের আলাদাভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয় যখন আলাদাভাবে পুরুষ দিবসের মতো কিছু পালন করা হয় না? এখানে কি পুরুষদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে না?” এর উত্তরটি হলো- আমাদের সমাজে নারীরা পিছিয়ে আছেন। বেশিরভাগ মানুষ নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়ে সচেতন না। এজন্য একটি বিশেষ দিনকে আলাদাভাবে নারী দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যাতে মানুষকে আবার নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যায় এবং লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আরেকটি সুযোগ দেওয়া যায়। আলাদাভাবে পুরুষ দিবস পালন না করে শুধুমাত্র নারী দিবস পালন করলে পুরুষের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে না কারণ, মূলত নারী-পুরুষ একই। তাদের পার্থক্য শুধুমাত্র লৈঙ্গিক জায়গায়। নারীরা পিছিয়ে আছে বলে তাদের টেনে পুরুষের সমান জায়গায় আনা কখনোই পুরুষের প্রতি বৈষম্য করা নয়। নারী দিবসকে ঘিরে আরেকটি বিতর্ক হলো-“প্রতিটি দিন-ই তো নারী দিবস। তাহলে আলাদাভাবে এই দিন পালন করার কি প্রয়োজন?” এটির জবাব হলো-প্রতিটি দিন-ই নারী দিবস এটি ভাবগত জায়গা থেকে বলা যায় কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই দিন আলাদাভাবে পালন করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি মানুষকে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; যা ‘প্রতিটি দিন-ই নারী দিবস’ হিসেবে থাকলে এর গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবে কমে যায়। নারীরা সেই আদিকাল থেকে পুরুষের সাথে আছে। তারা পুরুষের মতোই
প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুরুষকে বাদ দিয়ে যেমন প্রকৃতি অসম্পূর্ণ ঠিক সেভাবেই নারীকে বাদ দিয়ে প্রকৃতি অসম্পূর্ণ। আদিমযুগে পুরুষ পশু শিকার করেছে তো নারী কৃষি কাজ করেছে। এরপর পুরুষ সংসারের জন্য আয় করলে নারী সংসার গুছিয়েছে। এখন পুরুষ বাইরে কাজ করে অর্থ উপার্জন করলে নারীও ঠিক তাই করছে। তাছাড়া, যে যে-ই কাজ করুক না কেন কোন কাজ-ই ছোট নয় বরং, প্রতিটি কাজের নির্দিষ্ট গুরুত্ব আছে। কেউ নারীকে ‘অবলা’ বা ‘দুর্বল’ বলে সেক্সিজমের চর্চা করলে শুধুমাত্র সে নিজেই পিছিয়ে পড়ছে না, সে পৃথিবীর উন্নয়ন কাজকে ব্যাহত করছে। পুরুষ যেভাবে বাবা, পুত্র, ভাই, বন্ধু ঠিক সেভাবেই নারী মা, কন্যা, বোন, বন্ধু। নারীকে ‘মা জাতি’র ট্যাগ লাগিয়ে আপনি হয়তো নিজের অজান্তেই নারীকে ছোট করছেন। জানুন, শুনুন, বুঝুন- নারীর পরিচয় সে মানুষ। আর এর বাইরে তার ‘নারী পরিচয়’ সন্তান উৎপাদনের কাজ ছাড়া আর কোথাও ব্যাপার না।
নারী দিবস পালন সফল হোক। আর আমরা আশা করি, এইদিন খুব শীঘ্রই আসবে যখন নারী-পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের জন্য আমাদের আর আলাদাভাবে নারী দিবস পালন করতে হবে না। পৃথিবী শুধুমাত্র মানুষ এবং অন্যান্য সব জীবদের হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট