চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দানে ধন বাড়ে বিপদ দূর হয়

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ৪:২৬ অপরাহ্ণ

তোমাদের কাউকে মৃত্যু পেয়ে বসার পূর্বেই আমার দেয়া সম্পদ থেকে আমার পথে খরচ কর। মৃত্যু এসে পড়লে তখন বলবে, প্রভু আমার! আমাকে যদি আর সামান্য সময় সুযোগ দিতে, যাতে আমি কিছু দান সদকা করে আসতে পারতাম (মুনাফিকুন- ১০)। অন্যত্রে ইরশাদ হচ্ছে, যারা আল্ল­াহর পথে স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ এমন একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্ম নেয়। প্রত্যেকটি শীষে থাকে একশ করে দানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দ্বিগুণ করে দেন। আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত দানশীল, সর্বজ্ঞ। (বাকারা- ২৬১)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তির কাছে একদিনের খাবার আছে আর সে তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে ফেলেছে, তাকে আকাশ থেকে একজন ফেরেশতা এই বলে ডাকে! হে আল্লাহ’র ওলী! তোমার অতীত দিনের সকল গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতাআলার দরবারে প্রিয় দুটি গুণ হলো, আল্লাহর রাস্তায় দান করা এবং উত্তম চরিত্র (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)। তিনি ইরশাদ করেন, সদকা মানুষের বিপদ দূর করে, হায়াত বৃদ্ধি করে। দানশীলতা বেহেশতেরই একটি বৃক্ষ। আরো একটি হাদীসে রাসূল বলেন, দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর খুব কাছের এবং জাহান্নাম থেকে অনেক দূরে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিন শ্রেণির মানুষের আমলের পথ বন্ধ হয় না। প্রথমত: যে ব্যক্তি জীবনে দান-সদকা করে গেছে যথা মসজিদ, মাদরাসা নির্মাণ, পুল নির্মাণ, কুপ খনন ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত: যে ব্যক্তি এমন ইলম শিক্ষা করেছে ও শিক্ষা দিয়েছে, যা মানুষকে উপকৃত করে। তৃতীয় সেই ব্যক্তি যে নেক সন্তান দুনিয়াতে রেখে গেছে। (মুসলিম শরীফ)
দান-সদকার ক্ষেত্রে ইখলাস প্রয়োজনীয় বিষয়। হাদীস শরীফে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং আল্লাহর পথে দান-সদকা করার সময় যদি নিয়ত ঠিক থাকে, তাহলে পরিপূর্ণ ফায়েদা ও প্রতিদান পাওয়া যাবে। আর যদি নিয়ত ঠিক না থাকে তাহলে নেকী ও প্রতিদান বরবাদ হয়ে যাবে। অতিরিক্ত পাপের ভাগী হতে হবে। আমরা রাত-দিন নামায পড়ি, রোযা রাখি। সবই করি। কিন্তু আমাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই বরং যেমন ছিল তেমনি থাকে। এর অন্যতম কারণ হলো, আমাদের নিয়ত ঠিক নেই। আমরা সব কিছুই মুখে মুখে করি। একদা হযরত আলী (রা.) এর ঘরে খাবার নেই, টাকাও নেই। ফাতিমা (রা.) এর একটি চাদর নিয়ে গেছেন বিক্রি করা জন্যে। ছয় দেরহামে বিক্রি করে আসার পথে এক ভিক্ষুক হাত পেতে বসল। ফিরিয়ে দেবেন? না! পুরো ছয় দেরহামই দিয়ে দিলেন ভিক্ষুকের হাতে। ঘরের ক্ষুধার্ত মানুষের কথা মোটেও ভাবেননি, কিন্তু আল্লাহতাআলার কুদরত লক্ষ্য করুন! হযরত জিব্রাঈল (আ.) আরব্য গ্রাম্য মানুষের আকৃতিতে এসে হাজির। সাথে একটি উট। আলী (রা.) এর সামনে এসে বললেন, আলী তুমি কি এটা কিনবে? বাকী চাইলেও দেব! হযরত আলী (রা.) একশ দেরহাম বাকীতে কিনে নিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর হযরত মিকাঈল (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ। তিনিও এসেছেন মানুষের বেশে। তিনি বললেন, আলী! এটি যদি বিক্রি কর তাহলে আমি একশ ষাট দেরহাম দিয়ে কিনতে রাজী আছি। আলী (রা.) বললেন, রাজী আছি। অতএব একশ ষাট দেরহাম নিয়ে উট বুঝিয়ে দিলেন। ফেরার পথে সেই প্রথম ব্যক্তির সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ। তাকে দিয়ে দিলেন একশ দেরহাম। ষাট দেরহাম নিয়ে ঘরে ফিরলেন। হযরত ফাতিমা রা. দেখে তো তাজ্জব। ষাট দেরহাম! কোথায় পেলেন? কিভাবে পেলেন? আলী (রা.) বললেন, রাসূল (সা.) এর খেদমতে গিয়ে বিস্তারিত ঘটনা বলার পর রাসূল (সা.) ইরশাদ করলেন, ওই উটবিক্রেতা হলেন হযরত জিব্রাঈল! ক্রেতা হযরত মিকাঈল আর ওই উটটির উপর কিয়ামতের দিন হযরত ফাতিমা (রা.) সওয়ার হবেন। হযরত আলী (রা.) দিয়েছিলেন ছয় দেরহাম। পেয়েছেন ষাট দেরহাম। এক দেরহামের বিনিময়ে দশ।
একদা মদীনায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। খাদ্য নেই। সকলেই অস্থির। অবশেষে সকলে মিলে উপস্থিত হলো হযরত আবু বকর (রা.) এর দরবারে। সবাই আরয করল, আমীরুল মুমিনীন! আমাদের অবস্থা তো খুবই নাজুক। আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য দুআ করুন। যাতে আল্লাহ পাক আমাদেরকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করেন। অথবা মুক্তির অন্যকোন পথ বের করে দেন। হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, সবাই আল্লাহতাআলার দরবারে দুআ করব। ঘটনাক্রমে সেই রাতেই মদীনায় এসে পৌঁছায় হযরত উসমান গনি (রা.) এর খাদ্যবোঝাই বিরাট কাফেলা। হাজার হাজার মণ খাদ্যসামগ্রী। মদীনায় বিদ্যুতের গতিতে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। একদল এসে উপস্থিত হলো, খাদ্যসামগ্রী কেনার জন্যে। হযরত উসমান (রা.) এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের উদ্দেশ্যের কথা জানাল। তিনি জানতে চাইলেন, তোমরা কি দাম দিবে? তারা বলল, প্রতি পণ্যে এক দেরহাম লাভ দেব। উসমান (রা.) বললেন, তারপর? তারা বলল, এরচেয়ে বেশি দেয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব! উসমান (রা.) বললেন, যে ব্যক্তি প্রতি পণ্য সাতশ’ দেরহাম দিবে আমি এই সম্পদ তাকে দেব! অতপর উসমান (রা.) তা মদীনার মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। তখন সকলেই বলল, আপনি তো বলছিলেন যে ব্যক্তি প্রতি পণ্য সাতশ’ দেরহাম দিবে তাকে দেবেন। আর এখন তো ফ্রি বিতরণ করে দিলেন! উসমান রা. বললেন, শোন! সেই মহান সত্তা যিনি ওয়াদা করে রেখছেন, একের বিনিময়ে সাতশ দিবেন বলে, আমি তো তাঁকেই দিয়েছি। আর আমি পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি, প্রতি পণ্যের বিনিময়ে তাঁর দরবারে আমি সাতশ দেরহাম অবশ্যই পাব।
হযরত ফাতিমা (রা.) এর বিবাহের জন্যে একটি নতুন জামা তৈরি করা হয়েছিল। গায়ে ছিল একটি পুরাতন জামা। হঠাৎ এক ফকির এসে একটি জামা চাইল। তখন ফাতিমা (রা.) চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি কী নতুন জামাটা দেবেন, না পুরাতনটা। ভাবলেন, সে তো একটি পুরাতন জামাই চেয়েছে। পুরাতন দিলেই তো চলে। তারপর আবার ভাবলেন, এ কথা মনে হতেই ফকিরকে নতুন জামাটি দিয়ে দিলেন। উপস্থিত মহিলারা বলল, ফকির তো একটি পুরাতন জামা চেয়েছে। আপনি পুরাতন দিলেও পারতেন। নতুনটি দিলেন কেন? ফাতেমা (রা.) বললেন, আমার কাছে এটা পছন্দ হয়নি, যে আমি নতুন জামা পড়ব আর ভিক্ষুককে পুরাতন জামাটি দেব। নতুন জামাটিই আমার কাছে বেশি প্রিয়। আর আল্লাহর পথে প্রিয়বস্তু ব্যয় না করলে প্রতিদানের অংশীদার হওয়া যায় না। তাই আমি ভিক্ষুককে নতুনটি দিয়ে দিলাম।
কুরান হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস থেকে বুঝা গেল, দানে ধন বাড়ে বিপদ দূর হয়।

লেখক: মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী খতিব, জামিয়া বায়তুল করিম, চট্টগ্রাম।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট