চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

করোনার শিকার হয়ে চিরবিদায় নিলেন প্রবাসী চিকিৎসক বন্ধু : ডা. আবদুল মাবুদ চৌধুুরী ফয়সল

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

১২ এপ্রিল, ২০২০ | ১:০১ পূর্বাহ্ণ

করোনার নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পেল না ব্রিটিশ প্রবাসী চিকিৎসক বন্ধু ডা. আবদুল মাবুদ চৌধুুরী ফয়সল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচের এই মেধাবী শিক্ষার্থী মরণঘাতী করোনাভাইরাসের কাছে হেরে গেল গত ৮এপ্রিল লন্ডনের স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১০টায়। তার এমন মৃত্যুতে আমরা সুবর্ণ আটাশের বন্ধুরা হতবাক, বিমূঢ়, হতাশ। গত ২৫মার্চ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ভর্তি হয় ফয়সল। দীর্ঘ ১৪ দিন হাসপাতালের বেডে শ্বাসকষ্টের যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে অবশেষে মহান রাব্বুল আ’লামিনের সান্নিধ্যে চলে গেল আমাদের প্রিয় বন্ধু।
এ বছরের শেষের দিকে চমেক ২৮তম ব্যাচের মেগা রিইউনিয়ন হওয়ার কথা ছিল আর এই রিইউনিয়নের মূল নেতৃত্বে ছিল সদালাপী, সদাহাস্য ডা. ফয়সল। ও আর আসবে না, চলে গেছে চির দিনের জন্যে মাটির ঘরে। এভাবেই চলে যেতে হবে আমাদের সবাইকে এমনি করে। মৃত্যুর কাছে সবার পরাজয়-মৃত্যু কোন পরাভব মানে না, ‘(কিন্তু) কারো (নির্ধারিত) ‘সময়’ যখন এসে যাবে, তখন আল্লাহতায়ালা কখনোই তাকে (এক মুহূর্ত) অবকাশ দেবেন না; তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) যা কিছু করছো, আল্লাহতায়ালা সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত রয়েছেন’-সূরা আল্ মোনাফেকুন-১১।
১৯৮৫-৮৬ সালের কোন এক হিমেল শুভ্র সকালে আমরা ভর্তি হয়েছিলাম প্রাণপ্রিয় অঙ্গন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষে। উচ্ছল যৌবন নিয়ে এ অঙ্গনে ঘুরে বেড়ানো-এ ছিল যেন আজন্ম লালিত স্বপ্ন আমাদের। আদর্শিক বৈপরিত্যের কারণে অনেক সময় মান-অভিমানের নীরবতায় মিশে যেত আমাদের চারপাশ। নিমিষেই অহর্নিশ ভাটায় মিলিত হই একাকার। ছ’টি বছর লুকিয়ে রেখেছিলাম অতি সন্তর্পণে, শাদা রুমোলের ভেতর। সংসদ নেতা আতিকুজ্জামান, তিতাস মাহমুদ, মোহাম্মদ ইসমাইল, শাহাদাত হোসেন রোমেল, শাহিনুল আলম, কবি মোশ্তাক আহমেদ, আবদুর রব, মিজানুর রহমান মজুমদার (৯৩ সালের ১৮ অক্টোবর ব্রাশ ফায়ারে নিহত), মুজিব সিরাজী, মালেক ভাই, ইকো, রাজ্জাক, বাদল, কলিমুল্লাহ, ঝুমুর, মিতা, তাজিন, বর্ণা-আরো অনেকেই- যাদের সাথে চলত অব্যক্ত কথামালার ছড়াছড়ি। সে উদ্যমদেরই একজন আমাদের ছেড়ে চলে গেল- ভাবতে যেন গা শিউরে উঠে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে একটি ফোন এসেছিল ফয়সলের কাছ থেকে। রিইউনিয়নের ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। ও আমাকে তাগাদা দিচ্ছিল ২৮তম ব্যাচের বন্ধুদের সবাইকে অর্গানাইজ্ড করার জন্য। সেই শেষ কথা, আর কোন কথা হয়নি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে ওরা ৪ জন- রাজু, মিজান, জাবির ও শেষ সহযাত্রী ফয়সল। ওদের মতন এভাবে আমাদেরও চলে যেতে হবে নিঃসীম নিবাসে। যেখানে নেই কোন পাখির কলতান, মধুময় ঝর্ণাধারা আর দুর্বার বাতাসের মর্মর ধ্বনি।
সহীহ্ বোখারীতে বর্ণিত আছে: যাঁরা মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাঁরা পাবেন শাহাদাতের মর্যাদা। এরপরেও ফেরেশ্তাদের সওয়াল জবাব তো আছেই। ফয়সলের কবর দিয়ে শুরু হয়ে গেল তার কেয়ামতের প্রথম ধাপ, প্রথম স্টেশন, তাকে জিততেই হবে এখানে।
বেশ কিছুদিন ধরে সুবর্ণ আটাশের বন্ধুরা তার অসুস্থতা নিয়ে ারনবৎ একাউন্টে লেখালেখি করছিল, দেশ-বিদেশের বন্ধুরা বিভিন্ন স্ট্যাটাস ও বিভিন্ন কমেন্টে ভরিয়ে দিচ্ছে সুবর্ণ আটাশের পাতা। বিশেষ করে ফ্লোরিডা প্রবাসী রুমি আহমদ খানের আশাব্যঞ্চক স্ট্যাটাস দিয়ে অন্য বন্ধুদের মনে আশার সঞ্চার জাগাচ্ছিল। কিন্তু মহাশক্তিধর আল্লাহতায়ালার সিদ্ধান্তের কাছে আমরা করুণ অসহায়। আল্লাহতায়ালা তাঁর কিতাবে বলেছেন, ‘মৃত্যু যন্ত্রণার মুহূর্তটি (যখন) এসে হাজির হবে (তখন তাকে বলা হবে, ওহে নির্বোধ), এ হচ্ছে সে (মুহূর্ত)-টা, যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে’-সূরা ক্বাফ- ১৯। প্রাণের বন্ধু ফয়সলও মহিমাণি¦ত সত্তা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালার এ বিধানকে অস্বীকার করতে পারেনি। ওর মৃত্যুর খবরটা লন্ডনের মিডিয়াগুলোতে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে।
আমাদের দেশের এটিএন নিউজ গ্যালারিতে আমাদের আরেক বন্ধু ওহাইও প্রবাসী তিতাস মাহমুদ আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছে। লন্ডনের অতিপরিচিত ও জনপ্রিয় চিকিৎসক ও আমাদের পরম বন্ধু ফয়সলের মৃত্যুতে যেন ২৮-এর বন্ধুরা অসাড়-জড়পদার্থ। মহাবিশ্বের মহাবিষ্ময় মহাগ্রন্থ আল্-কোরআনের ভালোবাসায় উদ্ভাসিত হয়ে পুরোদস্তুর ৩ খতম কোরআন সম্পন্ন করেছে, সাথে কিছু অনুবাদসহ। বন্ধুর প্রতি বন্ধুদের ভালোবাসার এ ব্যতিক্রমী রূপ কখনো দেখিনি। এতো ভালোবাসে তারা ফয়সলকে।
১৯৯৩ সালে ইন্টার্নী শেষ করার পরপরই ও লন্ডন চলে যায়। পরে খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়া চলে যায়। জাম্বিয়া থেকে নধপশ করে লন্ডন চলে আসে। ভীষণ পরিশ্রমী ফয়সল জীবন সংগ্রামের এক অকুতোভয় বীর লন্ডনের জীবনযাত্রার সাথে নিজেকে সামলাতে গিয়ে জীবনভর সংগ্রাম করেছে। পূর্ব লন্ডনের ঐড়সবৎঃড়হ টহরাবৎংরঃু ঐড়ংঢ়রঃধষ এ ঈড়হংঁষঃধহঃ টৎড়ষড়মরংঃ হিসেবে কর্মরত ছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। যুক্তরাজ্যে যখন কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ে তখন ও বীরত্বের সাথে নেমে গেল এ যুদ্ধে। আর এ যুদ্ধে কাবু হয়ে ২৩ মার্চ ভর্তি হল ছঁববহং ঐড়ংঢ়রঃধষ-এ। লন্ডনের ঐড়ৎহপযঁৎপয এর ঊসবৎংড়হ ঢ়ধৎশ এ অবস্থিত ১ জড়পশপযধংব এধৎফবহং এর বাসায় রেখে গেল ১৭ বছরের ইনতিসার ও ওয়ারিছাকে।
সহধর্মীনি ডা. রেহেনা আক্তার রানী চট্টগ্রামের মেয়ে আর চমেক ৩২তম ব্যাচের ছাত্রী। ফয়সল এর দেশের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জ। ২০০৯ সালে চকরিয়ায় এক মর্মান্তিক সড়কদুর্ঘটনায় রানীর মা-বাবা মারা যান। তাঁদের নামে আগ্রাবাদে একটি চ্যারিটি হাসপাতাল রয়েছে। ব্রিটিশ আইন অনুসারে কোভিড-১৯ এ নিহত লাশগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু লন্ডনে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি তার লাশ কবরে দাফন করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেছে, যা এখন প্রক্রিয়াধীন। বন্ধু ফয়সল ছাড়া আমরা এখন আটাশ বন্ধুরা কিভাবে এত বড় শোক সইবো? কিন্তু এটাই নিয়ম। বুক ফেটে কান্না করতে ইচ্ছা করে।
কান্নায় কান্নায় যেন ভেসে যাই শ্রাবণের বারিধারায়। এ অমোঘ বিধান খর্ব করার অধিকার কেউ রাখে না। টষঃরসধঃবষু, ডব যধাব ঃড় মড় নধপশ ঃড় অষষযধয, ঃযব ভরহধষ ফবংঃরহধঃরড়হ-‘তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অত:পর তিনি (প্রত্যেকের জন্যে বাঁচার একটি) মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, (তেমনি তাদের মৃত্যুর জন্যেও) তাঁর কাছে একটি সুনির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে, তারপরও তোমরা সন্দেহে লিপ্ত আছো’- সূরা আল আনয়াম আয়াত-২।

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক সভাপতি, রাউজান ক্লাব; সিনিয়র কনসালটেন্ট, ইএনটি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট