চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত সুশাসন

আ.জ.ম. সামশুল হক

৪ এপ্রিল, ২০২০ | ১:৫৪ পূর্বাহ্ণ

দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সরকারি ভাষ্যমতে – দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রতিফলন কতটুকু, তা ভাবতে হবে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ২০৩০ সালে দারিদ্রমুক্ত হবে এবং ২০৪০ সালে দেশ উন্নত দেশের কাতারে যাবে। তাই এসবের জন্য দরকার সুশাসন। একটি দেশ যখন কোন লক্ষ্য স্থির করে, তখন স্বভাবতই সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ আসে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলেই উন্নয়নে গতি সঞ্চার হবে নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও শক্তিশালী করতে হবে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি বজায় রাখার পূর্বশর্ত গণতন্ত্র। সুসংহত গণতন্ত্র রাষ্ট্রের শক্তি, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, সহনশীলতা ও অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। গণতন্ত্র ও টেকসই উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক। উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পরিবেশ। তাই সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক উন্নয়নের উপকরণগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। মানবসম্পদকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে যথাযথ কাজে নিয়োজিত করা, প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারিত করা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানোসহ নানাবিধ কর্মকা-ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে। দেশে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান, তাদের ভিত শক্ত না হলে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলতে বিশেষতঃ ব্যাংক, বীমা এবং পুঁজিবাজারকে বুঝায়। খেলাপি ঋণসহ বহুবিধ কারণে ব্যাংকিং অবস্থা অবনতির দিকে। বলতে গেলে ব্যাংকিং খাতে দক্ষতার অভাব, নজরদারী এবং সুশাসন নেই। সর্বোপরি রয়েছে দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব। ব্যাংকের পরিচালকবৃন্দ নিয়ম-নীতির তোয়ক্কা না করে অস্বচ্ছভাবে টাকা লেনদেন করা মূল কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। জনগণ ব্যাংকের প্রকৃত মালিক হলেও পরিচালকেরা নিজেদেরকে ব্যাংকের মালিক দাবী করেন। তাতেই ব্যাংকের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ প্য়া। ব্যাংকিং সেক্টরে রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ না থাকলে সফলতা ও অগ্রগতি সম্ভব। বীমা খাতে গ্রাহকের দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চিত টাকা, মেয়াদ উত্তীর্ণ টাকা যথারীতি ফেরত প্রদান না করা, দাবী পরিশোধ না করা এবং মৃত্যুদাবীর ব্যাপারে গড়িমসি করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্যমতে ৬০ শতাংশের অধিক গ্রাহক এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী। এই বিষয়ে মনিটরিং সেল আবশ্যক। বিশ্ব সমীক্ষায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ভাল হলেও পুঁজিবাজার নিয়ে নানা টানাপোড়নে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে পুঁজিবাজারে। দেশের অগ্রগতির সাথে পঁুিজ বাজারের বড়ই ফারাক। এটি কাটাতে হলে পুঁজি বাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আনুপাতিক হারে সরকারের পক্ষ থেকে তারল্যের যোগান দিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতা বাড়লে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় খুবই জরুরী।
বিদেশে অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতির অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে অর্থ পাচার হতে থাকলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাটা পড়বে। এটা রোধ করা অপরিহার্য। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা অ্যাংকটাডের একটি প্রতিবেদন মতে, ৪৭টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশী। অর্থ পাচারের কারণে সঠিকভাবে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়ায় বৈদেশিক ঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা বাড়ছে। অর্থনীতির কাঠামো মজবুত করতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কর সংগ্রহের কোন বিকল্প নেই। সামাজিক খাত এবং পরিবেশ খাতকে গুরুত্ব দিতে হলে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। অর্থ পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের যে নীতিমালা আছে, যেমন -মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং রপ্তানীনীতি। এসবের বিষয়ে সাধারণ জনগণ অবহিত নয়। এগুলোর সুফল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌছে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি নড়বড়ে হয়, সেক্ষেত্রে তাদের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ এর কথা বলি, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কঠোর আইন করেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশের অবহেলা এবং অফিস কর্তৃপক্ষের মদদের কারণে তা কাযকরী হচ্ছে না। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরী। এই দেশে ব্যক্তি দুর্নীতির চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বড়ই প্রকট। এডিপি’র মাধ্যমে যে প্রকল্পগুলোর আর্থিক পলিসি নেওয়া হয়, মেয়াদ শেষে দেখা যায়, তাও সফল হয়নি। প্রকল্প তথা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে না পারলে উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়ন না হলে জনগণ এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। স্বাভাবিক কারণে এসব কিছু সুশাসনের আওতায় আনতে হবে।
দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কিছুদিন আগে জনগণের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সর্ব্বোচ্চ আদালত। প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন অথবা গুম করে কয়েক দিন পরে লাশ পাওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। আগে জনগণের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, তারপর অবকাঠামো উন্নয়ন। রাষ্ট্রের মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়। সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ এবং মাদক কারবারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রত্যাশা করে। মাদকের ছোবল থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর হুশিয়ারী থাকা সত্বেও মাদক কারবারীদের থামানো যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে মাদক সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি প্রয়োজন। দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারহীনতার কারণে অপরাধ দিন দিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। দেশের উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্ত এবং কলংকিত করছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা আইনের আশ্রয়ে অর্থাৎ থানায় যেতে ভয় পায়। প্রতিটি থানাকে জনবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ফুটপাত দখল এবং রাস্তা দখলের মত ঘটনা শহরে প্রায় সর্বত্র। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা দেখেও দেখে না। ব্যাটারীচালিত রিকশা, নছিমন, করিমন ও ভটভটিগুলো রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধ হলেও পুলিশের নাকের ডগায় অবাধে চলাচল করছে। বায়ুদূষণ এবং পরিবেশ দূষণ ঢাকা মহানগরের চিরচেনা রূপ। আমরা এ ব্যাধি থেকে এখনও বেড়িয়ে আসতে পারিনি। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা ও জটিলতা লক্ষ্যণীয়। অকপটে আমাদের স্বীকার করতে হয়- আমাদের রেমিট্যান্স বেড়েছে, রপ্তানী বেড়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি হয়েছে এবং কৃষিখাতে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। কিন্তু বহদলীয় রাজনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, নাগরিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কাঙ্খিত উন্নতি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুশাসন আলোর মুখ দেখাতে পারে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট