চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনা বদলে দেবে পৃথিবীর অর্থনীতি

মুহাম্মদ মুসা খান

৪ এপ্রিল, ২০২০ | ২:০০ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবী বর্তমানে ভয়ংকর এক দু:সময় অতিক্রম করছে, যা আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করছি। পৃথিবীর বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটিও এমন ভীতসন্ত্রস্ত চিত্র আগে কখনও দেখেনি। একটি মাত্র ভাইরাস যে, পুরো দুনিয়াকে লকডাউনে নিয়ে যেতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করেনি। পৃথিবীতে বর্তমানে রাষ্ট্র সংখ্যা দু’শ আটাশ, (স্বাধীন এবং স্বীকৃতিবিহীন মিলিয়ে)। এরমধ্যে প্রায় দু’শ রাষ্ট্রে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বর্তমানে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে ইতালি, স্পেন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। সব দেশ মিলিয়ে গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ১০ লাখ ১৫ হাজার ৪০৩ জন এবং মারা গেছেন ৫৩ হাজার ৩০ জন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ যেভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে আগাচ্ছে, তাতে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা লাখের ঘর অতিক্রম করার আশংকা করেছেন অনেকে। কারন এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জন্য ১৮ মাস সময়ের প্রয়োজন বলে জানা গেছে। এর পূর্বে আজকের মতো লকডাউনই ভরসা বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন।
করোনাভাইরাস শুধু যে প্রাণ সংহার করে চলেছে তা নয়, সমগ্র পৃথিবীর ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতির ভিতও নাড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীব্যাপি বিমান, নৌ, স্থলপথ সব কিছুই ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়েছে আমদানি-রফতানি, শিল্পকারখানা ও দোকানপাট। পর্যটন ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। করোনা সামলানোর পাশাপাশি অর্থনীতির মন্দা সামলাতে অনেক দেশ হিমশিম খাচ্ছে। ইতোমধ্যে তেলের দাম বিগত দেড়বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। প্রতি ব্যারেল ৫০ ডলারের তেলের দাম এখন ২২.৫৮ ডলারে নেমে এসেছে। বিগত ৮ মার্চ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ওপেক ও নন ওপেক দেশের প্রতিনিধিরা পরিস্থিতি বিবেচনা করে তেল উৎপাদন ১৫ লাখ ব্যারেল কমিয়ে দিয়েছে। তবে রাশিয়া তাদের প্রস্তাবের সাথে একমত হয়নি বলে জানা গেছে। তেলের দাম হ্রাস পাওয়াতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। কারন তাদের অধিকাংশই তেলের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যের এই নাজুক পরিস্থিতিতে আগামীতে শিল্পোন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশের অনুকূলে তাদের অনুদান-ঋণ কমাতে বাধ্য হবে। গত ২৬ মার্চ শিল্পোন্নত দেশের জোট জি-২০ তাঁদের ভার্চুয়াল সম্মেলনে সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি ও এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টি উঠে এসেছে। খুব দ্রুত বিশ্বের ২.৫০ কোটি মানুষ বেকার হবে বলে জানানো হয়েছে। তাছাড়া ৩.৪০ লাখ কোটি ডলার আয় কমবে বলেও তাঁরা উল্লেখ করেন। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশে কর্মী ছাটাই শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। কানাডাসহ অনেক দেশের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা ‘পার্টটাইম চাকরি’ হারিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে বলে জানা গেছে।
আইএলও’র (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন) মহাপরিচালক গাই বাইডার বলেছেন- ‘বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে, হোটেল বুকিং বাতিল হচ্ছে, গার্মেন্টস অর্ডার বাতিল হচ্ছে, কর্মঘণ্টা কমানো হয়েছে, বিক্রয়কর্মি, ওয়েটার, রাঁধুনি, কুলিমজুর, পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ নি¤œ আয়ের লাখলাখ কর্মীর চাকুরীচ্যুতির কারণে তাঁদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, ‘বেকারভাতা ও স্বাস্থ্যবীমা দিয়ে কিছু পূরনের চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক”।
সমগ্র বিশ্বের মত বাংলাদেশের চিত্রও একই। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত কম হলেও ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। লকডাউন পরিস্থিতিতে পরিবহন সেক্টরসহ মার্কেট-দোকানপাট বন্ধ থাকায় অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ পড়ছে। দৈনন্দিন খেটে খাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছে (যদিও সীমিত ভাবে কিছু সাবসিডি দেয়া হচ্ছে) । গার্মেন্টস সমূহের ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ায় এই শিল্পে বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ “দৈনিক রোজগারের” উপর নির্ভরশীল। লক ডাউন পরিস্থিতিতে তাঁরা ভীষণ অসুবিধায় পড়েছেন। শুধু বর্তমান পরিস্থিতি নয়, করোনাভাইরাসের সংকট কাটিয়ে উঠার পরও বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস ‘গার্মেন্টস’ ও প্রবাসীদের পাঠানো ‘রেমিটেন্স’ মারাত্মক ধ্বস নামতে পারে। সমস্যা দেখা দেবে ব্যাংক-বীমা সেক্টরে এমনিতেই কিছু ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ)। শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্টি হতে পারে সেশনজট। করোনাপরবর্তি সময়ে বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে ভয়াবহ ভাবে। ফলে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি এসব অপরাধ বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল যদি কঠোরভাবে দমন করা না হয়। তেলের দর হ্রাসের কারনে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ফলে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিদের ফেরত আসতে হবে। যার চাপ পড়বে দেশের উপর। আমাদের পর্যটনশিল্প এমনিতেই ছোট্ট। তার উপর করোনাপরিস্থিতি এই শিল্পকে অনিশ্চিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সংকট কাটানোর পরও পর্যটন শিল্প মাথা তুলে দাঁড়াতে অনেক সময় লেগে যাবে। বিশ্বের উন্নত দেশ গুলো যদিও দ্রুত তাদের সংকট কাটাতে পারবে (কারণ অর্থনীতির ভিত মজবুত), কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংকট মোকাবেলা করা কঠিন এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে অনেকে আশংকা করেছেন।
পৃথিবীর মানুষ আগে যেমন কলেরা, গুটি বসন্ত, স্প্যানিশ ফ্লু, সার্সসহ অনেক মহামারি নির্মূল করেছে, তেমনি করোনাভাইরাসের আজকের অপ্রতিরোধ্য গতিও নিশ্চয় মানুষ কিছুদিনের মধ্যে আটকিয়ে দেবে (এই প্রত্যাশা আমরা করতে পারি)। কিন্তু ততদিনে হয়তো এই মরণঘাতি ভাইরাস লক্ষ মানুষের প্রান সংহার করবে, অনেক পরিবারের ভিতরে থাকবে স্বজন হারানোর আর্তনাদ। লক্ষ-কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাহাড় মানুষের মাথায় চাপা থাকবে। তছনছ হয়ে যাবে বহু দেশ ও মানুষের পরিকল্পনা। কিন্তু তাই বলে মানুষ বসে থাকবে না, সভ্যতা স্তব্ধ হয়ে যাবে না (আগের মহামারিগুলোও সভ্যতাকে বন্দি করে রাখতে পারেনি)। হয়তো ছন্দপতন হবে। কিন্তু এই সংকট কাটানোর জন্য প্রয়োজন ‘লৌহকঠিন চ্যালেঞ্জ”, ‘দূরদর্শিতা’, ‘বাস্তব পরিকল্পনা’, ‘দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব’, ও ‘দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন’। আগে যেমন ধনী দেশগুলোর সাহায্য সহজে পাওয়া যেতো, আগামীতে সহজে সাহায্য পাওয়া যাবে না, যা অনেকটা নিশ্চিত বলা যায়।
সুতরাং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরে, অপ্রয়োজনীয় বরাদ্ধ কাটছাঁট করে, সম্পদের সুষম বণ্টন করে আমাদেরকে করোনাপরবর্তি সংকট মোকাবেলা করতে হবে। বেকাত্বের মত কঠিন সমস্যা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। অনেকে আশংকা করছেন, বিশ্ব অর্থনীতির নজিরবিহীন এই সংকট কাটাতে পাঁচ বছর লাগতে পারে। সুতরাং আমাদেরকেও সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আশাকরি সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা করোনাপরবর্তি অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো।

মুহাম্মদ মুসা খান কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট