চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাতই মার্চের বিকাল

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শিল্পিত রূপ

শাকিল আহমদ

১৩ মার্চ, ২০২০ | ২:৫৩ পূর্বাহ্ণ

‘সাতই মার্চের বিকাল’ যখন পাঠ নিতে শুরু করবে তখন স্বভাবতই একজন পাঠকের মনে হতে পারেÑএটি কী একটি আত্মজীবনী! নাকি ডায়েরি জাতীয় কিছু! আরো খানিকটা এগুলে মনে জাগতে পারে স্বাধীনতার ইতিহাস নয় তো? ডায়েরি, ইতিহাস কিংবা আত্মজৈবনিক ঢঙ হলেও হতে পারে উপন্যাসের উপাদান। শুরুতেই ইতিহাসের এক অনিবার্য চরিত্র রেণু (বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব), ক্রমান্বয়ে এসে যুক্ত হয় হাসিনা (বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা), রাসেল, রেহানা, শেখ কামাল, তাঁর বন্ধু, গায়ক আবদুল জব্বার। ধানম-ির সেই বত্রিশ নম্বর বাসভবন। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসছেন। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের বিকালে (রেসকোর্স ময়দানে) জনসভায় যাওয়ার সময় হয়েছে। এভাবে বত্রিশ নম্বর বাসভবন দিয়ে পটভূমির সূত্রপাত হয়ে সেই বত্রিশ নম্বর বাসভবনে পুনরায় এসে শেষ ‘সাত’ই মাচের্র বিকাল। কিন্তু মাঝখানে বয়ে যায় ঐতিহাসিক অমর বাণী, রক্তক্ষরণ। ঘটনার ঘনঘটা। এক মহান আত্মত্যাগের ইতিহাস। রচিত হয় লাল-সবুজের পতাকা। এতোসব ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান নিয়ে শেষ পর্যন্ত শিল্পের চাহিদা অক্ষুণœ রেখে শিল্পী সেলিনা হোসেনের তুলিতে চিত্রায়িত হয় এক কালজয়ী উপন্যাস, ‘সাতই মার্চের বিকাল’ (প্রকাশ-২০১৮)।
উপন্যাসের পটভূমিতে সাতই মার্চের ভাষণ মূল চালিকাশক্তি। আর এই স্লোগানকে শক্তিতে রূপান্তর করে ছড়িয়ে দিতে অন্যরকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কাহিনীর দুই প্রধান চরিত্র সাবিহা-আশরাফ। সাবিহা ভালো গান করে। রেণুর খুব পছন্দ ওর গান। বিশ^বিদ্যালয়ে হাসিনার দুই ক্লাস নিচে পরে। গান দিয়ে বিশ^বিদ্যালয় মাতিয়ে তোলে। সাবিহার কাছে রেণু একজন ইস্পাতদৃঢ়-মানুষ। দূর থেকে বত্রিশ নম্বরে তাকে দেখে তাই মনে হয়। ‘স্বাধীনতার প্রশ্নে আপনি আমাদের অপসহীন মা’-(পৃ. ১৯)। সাবিহার বন্ধু আশরাফ বলেছিল ওরা দু’জন এক সাথে রেসকোর্স ময়দানে যাবে। আশরাফও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাজনীতি সচেতন ছাত্র। হাতের প্ল্যাকার্ড সাবিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে এটাই তোমার জন্য। আমার গোলাপ। প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে সাবিহা বলে, ‘জয় বাংলা’। সাবিহা আর আশরাফ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ মনোযোগ দিয়ে শোনে। সাতই মার্চের ভাষণ শুনে সাহিবা মনে জাগেÑএই সময়ই হবে আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমরা এক শ্রেষ্ঠ সময়ের মানুষ। আজকের বিকেল আমাদের স্বপ্নকে গাঢ় করার জন্য আকাশে রঙ ছড়িয়েছে। ভাষণ শুনতে শুনতেÑআশরাফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সাবিহা বলে, ‘বঙ্গবন্ধু কিন্তু এই বাংলাদেশে বলেছেন। এই পূর্ব পাকিস্তানে বলেন নি। ঠিক। দেশের নতুন নাম বলেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণার আর বাকি থাকল কী” (পৃ. ৩৫)। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে সাবিহা-আশরাফের হৃদয়ের তন্ত্রিতে শিহরণ জাগায়, এক অনুভূতিও সঞ্চারিত হয়। প্রকৃতপক্ষে সেদিন রেসকোর্স মাঠে অবস্থানকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের অনুভূতি-অভিব্যক্তি ছিল তাদেরই মতো। সাবিহা-আশরাফের কথোপকথন এবং বক্তব্যের নানা পর্যালোচনার মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর পুরো ভাষণটি শেষ হয়। লেখক অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে পুরো ভাষণটির উদ্ধৃতি কাহিনীর গতিময়তার ভাঁজে ভাঁজে বিধৃত করেছেন। লক্ষজনতার মাঝে রেসকোর্স ময়দানে সাধারণ মানুষের কাতারে ছিল বাদাম বিক্রেতে নূরুল। ভিক্ষারত বুড়ি মা। ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, পথচারি, হাসপাতালে মা অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা সন্তান দোলাও। সেই মাঠে উপস্থিত ছিলেন হাসিনা, রেহানা, শেলী, জেলী। সভাশেষে সাবিহা তাদের সাথে দেখা করতে যায়। সেদিন কল রেডির মালিক হরিপদ ঘোষও দয়াল ঘোষের মাইকগুলিও ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর আজকের ভাষণ মানুষের ভেতরটা যে নাড়িয়ে দিয়েছে। ঐক্যবদ্ধ করেছে তা সহজেই বুঝে নেয় আশরাফ-সাবিহা। তারা দু’জনের আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আছে এবং স্বাধীনতার ঘোষণার যে ইংগিত রয়েছে তারও ব্যাখ্যা আছে। উপন্যাসের ২৭পৃ.-৪৪পৃ. পর্যন্ত সাতই মার্চের ভাষণের দীর্ঘ বর্ণনা আশরাফ-সাবিহা কথোপথনের মধ্যদিয়ে শিল্পরসকে অক্ষুণœ রেখে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চিত্রায়িত করেছেন লেখক এভাবেÑ “ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-এ। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল: প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।”Ñহু ররে যুদ্ধ যুদ্ধ। আশরাফের কণ্ঠস্বর ঢেকে যায় গগনবিদায়ী স্লোগানের তীব্রতায়Ñ “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো। বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পদ্মা মেঘনা যমুনা। তোমার আমার ঠিকানা। বীর বাঙালি অস্ত্র….সাতই মার্চের রেসকোর্স ময়দানের এই বিকাল সাবিহার সামনে পৃথিবীর সবক’টি সপ্তম আশ্চার্যের দরজা খুলে দেয়।” (পৃ. ৩৬-৩৭)। কাহিনীর এক যৌক্তিক সংলাপের মধ্যদিয়ে কুশলী শিল্পী সেলিনা হোসেন ভাষণের প্রতিটি স্তবক উপন্যাসের পটভূমির পরতে পরতে বিন্যস্ত করেছেন যা পাঠককে চমকে দেয়। অভিভূত করে। এই উপনাসকে নিয়ে যায় এক অনন্য মাত্রায়।
রেসকোর্স’র ভাষণের পর উপন্যাসের গতি ভিন্ন মাত্রায় রূপ নেয়। সাবিহা-আশরাফ এবং তাদের সহপাঠিরা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে যুদ্ধের শপথ নিয়ে ছিটকে পড়ে শহর, বন্দর, গ্রামে। খেয়া পারাপারের সময়ও ভাষণের আমেজ নদী-কুল-কুল ধ্বনি আর মাঝির নৌকার দাঁড়ের শব্দের সাথে সাথে শুরু মেলায়। সাবিহার বাবা তমলিম এবং কাকু ননী গোপাল যেন সাবিহার গায়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ভাষণের গন্ধ খুঁজে পায়। এভাবে লেখক সংলাপ সৃষ্টিতেই সাত মার্চের ভাষণের আমেজ সারা বাংলায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। যা সে সময়েরই ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল। সাবিহার গ্রামে ফিরে যাওয়া মানে সাতই মার্চের টানটান উত্তেজনাও বিশখালী নদীতীরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া। সাবিহার সামনে আবার পুরোগ্রাম সাতই মার্চের বিকেলের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মা আমেনাও যেন মেয়ের আগমনী বার্তা শুনতে পায় স্লোগানের মধ্যদিয়ে। লেখকের বর্ণনাগুলো সেই গ্রামে এমন এক আমেজ সৃষ্টি হয়েছে যেন সাবিহা নয়, গ্রামে আসছেন বঙ্গবন্ধু নিজেই সাতই সার্চের ভাষণ নিয়ে। বিশখালী নদীর এটুকু পথ পারি দিয়ে সাবিহা এখনো ঘরে ফিরতে পারছে না। এখানে সবায় যেন স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এদৃশ্য দেখে সাবিহার মনও খুশিতে আনচান হয়ে ওঠে। নৌকার মাঝি ননী গোপালের একটি উক্তিই যেন সমগ্রদেশের চিত্র উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।Ñ“ না দাদা-জয় বাংলার নৌকা চুরি করতে পারবে না”। আন্দোলনের সূচনা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে রমনার রেসকোর্স মর্যদান হয়ে বিশখালী নদী পার হয়ে সুদূর অজপাড়া গাঁয়ে গিয়েও ঢেউ লেগেছে। বঙ্গবন্ধুর অমর কাব্যগাথা স্বাধীনতার স্বপ্ন গ্রামের সাধারণ কৃষক, মজুর, মাঝিও খেটে খাওয়া মানুষ এবং বিশ^বিদ্যালয়ে পড়–য়া সাবিহার পরিবারেও লেগেছে।
‘সাতই মার্চের বিকাল’ উপন্যাসের পটভূমিকে সময়ের মাপকাঠিতে চারটি স্তরে বিন্যাস করা যায়। উপন্যাসের প্রারম্ভ পর্বে রয়েছে বত্রিশ নম্বর বাসভবন। যেখান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাতই মার্চের ভাষণ রেসকোর্স ময়দানে) দেওয়ার পূর্বে একটি মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছেন। বত্রিশ নম্বরের এই বিকাল বেলাকে উপন্যাসিক তাঁর এক অবিস্মরণীয় বর্ণনায় জীবন্ত করে তুলেছেন। বত্রিশ নম্বরের এই বিকালের বর্ণনা ইতিহাসকে অতিক্রম করে এক মহান শিল্পের মানদ-ে উপনীত হয়েছে। পরবর্তী ঘটনা রেসকোর্স ময়দানে সাতই মার্চের ভাষণ যা বিশে^ এক মহাকাব্যিক মানদ-ে উপনীত হয়েছে। এখানেও ঔপন্যাসিক ইতিহাসের অনিবার্য বাণীকে উপন্যাসের পটভূমিতে দাঁড় করানোর এক দূরসাহসিক পদক্ষেপে সফল হয়েছেন। পরবর্তী অংশে দেখা যায় সাতই মার্চের ভাষণকে উপজীব্য করে বাঙালির প্রতিটি ঘরে ঘরে যুদ্ধ জয়ের দুর্গ তৈরি হতে। লেখকের বর্ণনা গুণে এটিও একটি উপন্যাসের সফল অধ্যায়। শেষ পর্বে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল পটভূমি। যেই পটভূমি চিত্রায়নে অধিকাংশ উপন্যাসিকই সফল হতে পারেনি। নয় মাসেরও মুক্তিযুদ্ধ বস্তুত একটি বিশাল ক্যাম্পাস। মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি করে গত প্রায় পাঁচ দশকে আমাদের কথাসাহিত্যের কম উপন্যাস রচিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের আদ্যোপান্ত ঘটনাকে বেষ্টন করে এক মহাকাব্যিক উপন্যাস এখনো রচিত হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধের এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের খ- খ- চিত্রকে ধারণ করে অনেক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম রয়েছে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ের স্বপ্ন-ভঙ্গের কথা, আহত, পঙ্গু মুক্তিযুদ্ধাদের যাতনার কথা, সমাজ-বাস্তবতার বেষ্টনে অধিকতর প্রাধান্য পেয়ে আসছিল মুক্তিযুদ্ধের কথাসাহিত্যসমূহে। স্বপ্নভঙ্গের যাতনার কথা তুলে ধরতে গিয়ে অনেকটাই ঢাকা পড়েছিল গৌরবময় রণাঙ্গনের কথা। সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনাকে বেষ্টন করে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ষোলই ডিসেম্বর হয়ে মার্চে এসে পটভূমির পরিসমাপ্তি ঘটে। এই পর্বে যুক্ত হয়েছে অনেক খ- খ- মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা। এসব ঘটনা বিশ্লেষণে উপনীত হওয়া যায় যুদ্ধের এই বিশাল ক্যাম্পাসকে কাহিনীর শেষাংশে এসে কতটুকু ধারণ করতে সামর্থ্য হয়েছেন। নাকি অপরাপর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোর মতো গা-ভাসিয়েছেন।
‘সাতই মার্চের বিকাল’ উপন্যাসের শেষাংশে মুক্তিযুদ্ধের অনেক খ- খ- চিত্রের অবতারণা ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন লেখক। এ-সব ঘটনার-ঘনঘটার মধ্যদিয়ে একটি সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধের চালচিত্র দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সাতই মার্চের ভাষণের পর থেকে যে যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারও একটি বর্ণনা ওঠে এসেছে। মূলত এই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ই ছিল তখন আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম পিঠস্থান। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল তাও আখ্যানে উঠে এসেছে। রোকেয়া হলের সাবিহার গ্রামে গিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ছাবিশ মার্চের ভোরে ইকবাল হলের ছাত্র-আশরাফ, নয়ন, বাদল, বিপ্লব-এর ঢাকা ছেড়ে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা এসব অনুষঙ্গ মূলত এক একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তবে, এসব চরিত্রগুলোকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে ধরে নিয়ে আরো জীবন ঘনিষ্ঠ বর্ণনা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে উপস্থাপন করতে পারলে সেই সময়কার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকাটা উপন্যাসে শৈল্পিকভাবে জীবন্ত হয়ে ধরা দিতো।
যুদ্ধ শুরুর মাত্র দু’দিন আগে যে ইপিয়ার বাহিনীকে নিরস্ত্র করা হয়েছে। তেইশ মার্চের ঘটনা মনে করতেই কেঁদে ফেলে আশরাফের বন্ধু নয়ন। কী সাহসী হয়ে উঠেছিল সেদিন ইপিয়ারের বাঙালি সদস্যরা। ল্যান্সনায়েক বাশারের নেতৃত্বে পিলখানার প্যারেড গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল ওরা। সেদিন স্বাধীনতার সংগ্রামে শুধুমাত্র ছাত্ররা অংশ নেয়নি, অংশ নিয়েছে বাসার দারোয়ান ফজল ভাই।
ইপিআর সদস্য আবদুল গনি, জিনি পঁচিশ তারিখ ডিউটি থাকাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। এরপর পঁচিশের রাত তার জীবনের স্মরণীয় রাত ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। রাজার বাগ পুলিশ লাইন্স-এ পঁচিশে মার্চ রাত দশটার পর মোটর বাইকে করে শেখ কামাল প্রবেশ করেন। “তিনি আমাকে বলেন, পাকিস্তান সেনারা রাতে আক্রমণ করবে। বঙ্গবন্ধু পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণ মোকাবেলা করতে নির্দেশ দিয়েছে। এখবর পুলিশ সদস্যদের কাছে এখনই পৌঁছাতে হবে। কথা কয়টি বলে মোটর বাইক চালিয়ে তিনি চলে যেতে শুরু করলে আমি দৌড়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করি আপনি কে? আমাকে আপনার কথা বলেন, আমি সবাইকে আপনার কথা বলব। তিনি বললেন, আমি শেখ কামাল।” (পৃ.১১৫)। বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা আবদুল গনি পুলিশ সদস্যকে জানানোর জন্য পাগলাঘণ্টা ব্যবহার করে সবাইকে সালামি গার্ডের সামনে নিয়ে এসে তালা ভেঙে অস্ত্রাগারের ভেতরে ঢুকে সারি সারি সাজানো থ্রি নট-থ্রি রইফেল আর গোলাবারুদ সবার হাতে ধরিয়ে দেয়। রাত বারটায় শুরু হয় আক্রমণ। পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতের যে বর্ণনা উপন্যাসে আবদুল গনির জবানিতে উঠে এসেছে তাও ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ-সব ঘটনার বর্ণনা এক একটি ইতিহাসের অংশ। যা শৈল্পিকভাবে কাহিনীর প্রতিটি পরতে পরতে স্থান করে নিয়েছে পুরো উপন্যাসটিতে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অত্যাচার-নির্যাতনের একটি বড় ভূমিকায় ছিল এদেশীয় কিছু রাজাকার-আলবদর বাহিনী। এই দোসরদের হাত থেকে রেহায় পায়নি আমাদের মা-বোনের ইজ্জত। মুক্তিযুদ্ধের কথাসাহিত্যে এই রাজাকার-আলবদরদের সেসব ঘটনা নানাভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন ও এসব চিত্রায়নে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাবিহাদের এলাকার রাজ্জাক চেয়ারম্যান আমাদের হাজারো গ্রামের যেসব চেয়ারম্যান রাজাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নানা লুটতরাজ নারীদেরকে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া এবং হত্যাকা-ে মেতে উঠেছিল তার এক অন্যতম প্রতিনিধি। সাবিহার চেয়ারম্যান চাচাকে এ-ভাবে চোখের সামনে বদলে যেতে দেখাটা ছিল সে সময়কার সমাজ প্রেক্ষাপটে এক স্বাভাবিক ঘটনা। “শেখ মজিবরের অত্যাচারের ঠেলায় কেউ ঢাকায় থাকতে পারলা না!” চেয়ারম্যানের এমন মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করায় সাবিহাকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে বলেÑ“বেশী বাড়াবাড়ি করলে আর্মির হাতে তুলে দেব। টের পাবে কত ধানে কত চাল। যাও। বাড়ি যাও। তোমার বাপকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।” (পৃ.-৯৫)। চেয়ারম্যানের রক্তচক্ষুর মধ্যদিয়েই ঘটনার শেষ হয়নি। পরবর্তীতে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে সাবিহার পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদেয়কে নানাভাবে সহযোগিতা করার অপরাধে এই রাজ্জাক চেয়ারম্যান পাকহানাদার বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করে মা,বাবা, ছোট ভাইকে। তুলে নিয়ে যায় ছোটবোন সাহানাকে। নারী মুক্তিযোদ্ধা সাবিহার পরিবারের এই করুণ পরিণতি যুদ্ধচলাকালীন হাজারো পরিবারের প্রতিচ্ছবি, যা ঔপন্যাসিকের তুলিতে স্থান করে নিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের বিশাল পটভূমিকে ধারণ করে রচিত ‘সাতই মার্চের বিকাল’ উপন্যাসের অন্যতম প্রাণশক্তি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানে সাতই মার্চের ভাষণ। আর এই ভাষণের অন্যতম চালিকাশক্তি উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র সাবিহা-আশরা। এই দুই মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র চিত্রণে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এক সফল রূপকার। মুক্তিযুদ্ধে সাবিহা এক সাহসী। দেশমাত্রিকার জন্য নির্ভীক লড়াকু সৈনিক চরিত্র। সাতই মার্চের ভাষণের পর থেকে তার মাথায় আর রক্তে যুদ্ধ এবং দেশকে স্বাধীন করা ছাড়া অন্য কোন বিষয় কাজ করে না। দেশ পত্রিকার জন্য সাবিহা মানসিকভাবে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে গেরিলা আক্রমণ করে প্রথমবার সফলভাবে ফিরে আসে। মুক্তিযুদ্ধে সাবিহা বাহিনীর মতো এতো সাহসী নারীদল সত্যি গঠিত হয়েছিল কীনা জানি না। তবে ঔপন্যাসিকের বর্ণনা কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে এ’টিকে এক উচ্চতর মাত্রায় আসীন করেছে। আমাদের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধ এবং গেরিলা যুদ্ধের বর্ণনা খুব একটা উঠে আসেনি। সাবিহা এবং আশরাফের দুই জায়গায় গেরিলা অপারেশন প্রথমবারের মতো পরপর সংগঠিত হয় অত্যন্ত সফলভাবেই। লেখক অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে নাটকীয়ভাবে উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্রের গেরিলা যুদ্ধের ভূমিকা তুলে ধরন।Ñ“নয়ন প্রশ্ন করে, কিন্তু মাইন পোতার কাজ কে করবে? সাবিহা ও সাহসী যোদ্ধা। ওকে তুমি একটু ট্রেনিং দিলেই ও তাড়াতাড়ি বুঝে নিতে পারবে। সাবিহার দিকে তাকায় নয়ন। Ñএটা খুব রিস্কি কাজ। যে কোন সময় প্রাণ চলে যেতে পারে। Ñদেশের জন্য যখন যুদ্ধে নেমেছি তখন মৃত্যুর ভয় নেই। কমান্ডার সাবিহার কথায় সায় দিয়ে বলে, সাবিহার সঙ্গে টিমে থাকবে করুনা, বুলা, আফিয়া, চন্দনা। ওরা সবাই খুব সাহসী।” (পৃ.১৪৬)। সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ নারী মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্র আমাদের উপন্যাসে খুব একটা উঠে আসেনি। সাতই মার্চের বিকালÑএক্ষেত্রে এক অনন্য সংযোজন। একজন কমান্ডার হাতে ধুরিয়ে ধরিয়ে কীভাবে সাধারণকে অসাধারণ যোদ্ধায় পরিণত করে তোলছে তারও সুনিপুণ ব্যাখ্যা আছে। যেমনÑ“চন্দনা জিজ্ঞাস করে, কমান্ডার, শত্রুরা কতদূরে থাকলে এসএল আরের গুলি তাদের গায়ে লাগবে? একশ পঁচাত্তর থেকে দুই’শ গজ পর্যন্ত রেঞ্জের জন্য এটি একটি নির্ভরযোগ্য অস্ত্র।” (পৃ. ১৪৩)। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস মাত্রই দেখানো হয়েছে হিন্দু নারী মানেই শরণার্থী শিবিরে চলে যাওয়ার এক ব্যথিত চিত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম চরিত্র বিজয়া দিদি। Ñ“দিদি তোমার হাতে অস্ত্র? Ñতোমার বিজয়া দিদি আর আগের দিদি নেই। সোহানপুরে ট্রেনিং নিয়েছি। তারপর কমান্ডার পাঠিয়ে দিলো তোমার ক্যাম্পে”। মুক্তিযুদ্ধের নারী চরিত্র চিত্রণে এ ধারার চরিত্র সৃষ্টি একান্তই ব্যতিক্রম হলেও অবাস্তব মনে হয়নি। যুদ্ধকালীন সময়ের আর এক করুণ আর্তি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নারীদের ওপর পাকবাহিনীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা। দ্বিতীয়বার গেরিলা যুদ্ধে পাকবাহিনীদের হাতে ধরা পরে সাবিহা। হানাদার বাহিনীর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে প্রচ-রকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে ভেঙে না পরে নির্যাতন কক্ষের অপরাপর নির্যাতিতা সাধারণ নারীদেরকে শক্তি ও সাহস যোগায় সাবিহা। অত্যাচারিত নারী সমাজের মনোবলকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে সাবিহা চরিত্র মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস এক নতুন সংযোজন। জীবনের এক কঠিনতর সময়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও স্বাদ যে তাদের জীবন থেকে ফুরিয়ে যায়নি। জীবন যে নিঃশেষ হয়ে যায়নি তারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন সাবিহা চরিত্রের মধ্য দিয়ে।
আখ্যায়নের বুননে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে মনে প্রাণে ধারণ করে অন্যতম এক লড়াকু সৈনিক বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র আশরাফ। যুদ্ধের একটি ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আশরাফ সাবিহার ভালবাসার স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু সাবিহার ক্ষেত্রে যুদ্ধের ময়দানে এক কঠোরতম সৈনিকের মনোভাবকে উজ্জীবিত রেখে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে লড়েছে। এক্ষেত্রে আবেগ সচেতন লেখক তাঁর কলম চালনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সীমারেখা মেনে অগ্রসর হয়েছেন বলেই একজন প্রকৃত নায়কোচিত মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র চিত্রণে সফল হয়েছেন। বার কয়েক গেরিলা যুদ্ধে সফল অংশগ্রহণের এক পর্যায়ে নিজের অঙ্গহানী এবং প্রিয়তমার নারীত্বের বিসর্জনের মধ্য দিয়ে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের এক মহানায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বস্তুত একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা যেমনটি হওয়া প্রয়োজন ঔপন্যাসিক ঠিক সেভাবেই চিত্রায়িত করেছেন আশরাফ চরিত্র। যুদ্ধশেষে সাবিহা-আশরাফের প্রথম দেখাতেই যদিও দু’জনের জীবন থেকে অনেক মূল্যবান জিনিস হারিয়ে গেছে তথাপি দু’জনের মনে এর কোন নেই অনুশোচনা। বরং একজন অন্য জনকে আলিঙ্গন করে নেয় এভাবেÑদু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে ছিল মুহূর্তমাত্র। তারপর হাসিমুখে বলেছিল আমার কোন দুঃখ নেই। Ñআমারও না। যা কিছু ঘটেছে তার সবটুকুই স্বাধীনতার জন্য। আমাদের স্বাধীনতা পাওয়া হয়েছে।” পৃ. (১৭৬)। যুদ্ধে আশরাফ একটি হাত হারিয়েছে আর সাবিহা হারিয়েছে তার নারীত্ব। এই হারানো দেশের স্বাধীনতা অর্জনের কাছে যেন কিছুই না। বৃহৎ হৃদয়ের অধিকারী দুই মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র চিত্রণের মধ্যদিয়ে লেখক আমাদের সমগ্র মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে সমাজের এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অথচ আমাদের অপরাপর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের এক স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় আক্রান্তের কথা। সাতই মার্চের বিকালকে বেষ্টন করে পুরো উপন্যাসের শুরু এবং সমাপ্তি। এই স্বাধীনতা সাতই মার্চের স্বাধীনতা। সাতই মার্চের বিকালের আর এক স্বপ্নদ্রষ্টা বত্রিশ নম্বর বাসভবনের রেণুর কাছে ফিরে যায় আশরাফ-সাবিহা। রেণু নিজের গলার চেইন খুলে সাবিহার গলায় পরিয়ে দিয়ে তাদের বিয়ে সম্পন্ন করে। উদার হৃদয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা যুগলকে বরণ করার মধ্যদিয়েই তিনি মূলত এক বঙ্গমাতা। এখানে শিল্পীর তুলি জীবনের এক গভীরতম উপলব্ধি থেকে উৎসারিত বলেই এই সৃষ্টিকর্ম কালের সাক্ষী হয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে প্রতিনিধিত্ব করবে।
সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের পাঠক মাত্রই জীবন-জীবিকা, সময়-সমকাল ও শিল্পরসের গভীরতম উপলব্ধির বাইরে অতিরিক্ত কিছু মেনে নিতে পারে না। এতো শিল্প সচেতনতার মধ্যেও এই উপন্যাসের কোথাও কোথাও আবেগের আতিশয্য, অতিমাত্রায় ঘটনার বর্ণনা কিংবা অতিনাটকীয় ঘটনার অবতারণাও লক্ষণীয়। যেমনÑসাবিহার বাবা তসলিম, মা আমেনা, ছোট ভাই আরিফ এবং বোন সাহানাকে নিয়েই যে সংসার-তাদের মধ্যে যে উত্তেজনা, স্বাধীনতা লাভের যে স্বপ্ন বর্ণনার যে আতিশয্য তা অনেক সময় যুদ্ধ পূর্বসময়ের চলচ্চিত্রকে ছাপিয়ে অতিকথনে, অতি ভাবনায় প্লাবিত হয়েছে। সাবিহার পরিবারের চরিত্রসমূহের বিষয় বর্ণনাতেও অনেক সময় এই অতিরঞ্জন লক্ষণীয়। সাতই মার্চের ভাষণের সময় রেসকোর্স মাঠে সাবিহা-আশরাফের সাথে পরিচয় হয়েছিল বাদাম বিক্রেতা নুরুল, ভিক্ষারত বুড়ি মা, রিকশাওয়ালার সাথে। কিন্তু নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরও স্বাধীন দেশের সাতই মার্চের বিকালে নাটকীয়ভাবে সেই রেসকোর্স মাঠে সাবিহা-আশরাফের সাথে আবারও তাদের দেখা হওয়া খানিকটা আরোপিত এবং ছন্দপতন মনে হয়। আরো আরোপিত মনে হয় সমগ্র উপন্যাসে যে কোন পরিস্থিতিতে, যে কোন ঘটনার মধ্যে সাতই মার্চের ভাষণ ও সংযুক্তকরণ। যদিও এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণকেই কেন্দ্র করে উপন্যাসটির পটভূমি পল্লবিত হয়ে ওঠে। তথাপি শিল্প সৌন্দর্যের চাহিদাকেও অক্ষুণœ রাখা সচেতন শিল্প সত্তার পরিচায়ক। এক্ষেত্রে ঔপন্যাসিককে আরো সচেতনভাবে যুৎসই স্থানে ভাষণের উদ্ধৃতিসমূহ ব্যবহারের প্রবণতা দেখাতে পারলে শিল্প সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেতো।
বত্রিশ নম্বর বাসবনে সাতই মার্চের বিকাল, রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ, ভাষণের পর যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং সর্বোপরি সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তরের এই বিশাল পটভূমিকে একসাথে ধারণ করে গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে আর কেউ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লেখায় হাত দেননি। তবে এই বিশাল পটভূমিকে মাত্র ১৮৪ পৃষ্ঠায় বন্দী করতে গিয়ে একাত্তরের উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ এতে জায়গা করে নিলেও কিছু কিছু বিষয় অনুল্লেখিতই থেকে গেছে। বাদপড়া বিষয়গুলোও সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের সাথে গভীর সম্পর্ক যুক্ত। যেমন-অস্থায়ী সরকার গঠন ও এর ভূমিকা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা আমাদের দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা। যুদ্ধের সময় পাক হানাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার করুণচিত্র। এসব উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীও উপন্যাসে সংযুক্ত হলে পরে ‘সাতই মার্চের বিকাল’ এক বিশাল ক্যাম্পাসে হতে পারতো গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বাংলা কথা সাহিত্যে সর্বোৎকৃষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস।
আমাদের কথাসাহিত্যকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে গুটিকতেক কথাশিল্পী বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদেরও একজন অগ্রগণ্য কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। তাঁর বহুল প্রচারিত, বহুপঠিত, বহুভাষায় অনুদিত। সফল চলচ্চিত্র কাহিনী হিসেবে বিবেচিত, বিশে^র উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠ্য তালিকাভুক্ত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘হাঙর নদী ‘গ্রেনেড’ ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত (৪ এপ্রিল থেকে ১০ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে লিখিত) হওয়ার পর থেকে তাঁকে আর পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিরীক্ষাধর্মী লেখক সময়-সমাজ-যাপিত জীবন এবং ঘটনাকে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে এ যাবতকাল শুধু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস রচনা করেছেন চল্লিশের অধিক। ইংরেজি, ফরাসি, জাপানি, কোরিয়ান, রুশ, মালে, উর্দু, হিন্দি, কন্নড়, মালয়ালাম, মারাঠি, ফিনিস ও আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর অনেক গল্প-উপন্যাস। স্বাধীনতা লাভের প্রায় পাঁচ দশক পর (২০১৮) এসে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের বিশার পটভূমিকে ধারণ করে আনুপূর্বিক বর্ণনায় ‘সাতই মার্চের বিকাল’ রচনা করে আর এক নবতর অধ্যায়ের সূচনা করলেন বাংলা সাহিত্যে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সার্বক্ষণিক প্রাণশক্তি যুগিয়েছে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ। মূলত রেসকোর্স ময়দানের সাতই মার্চের ভাষণকে মূল উপজীব্য করে ‘সাতই মার্চের বিকাল’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্ভর এই উপন্যাসটি পল্লবিত হয়ে ওঠে।Ñ“ এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।” এই মহাকাব্যিক আহ্বান শেষ পর্যন্ত একটি সম্মুখযুদ্ধের রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী ভাষণ ও দিকনির্দেশনাকে কথা সাহিত্যের রূপদিয়ে এতো বস্তুনিষ্ঠ বলিষ্ঠ শিল্পরস সমৃদ্ধ উপন্যাস দ্বিতীয়টি রচিত হয়নি।
যে কোন বিষয়ভিত্তিক পটভূমিতে অনুষঙ্গ করে উপন্যাস রচনা একজন শিল্পীর জন্য দুরূহ তো বটেই অনেকটা জটিল কাজও বটে। ইতিহাসের সঙ্গে যোগসূত্র ঘটিয়ে প্রকৃত শিল্পের সমন্বয় কিন্তু একজন বড়মাপের শিল্পীর পক্ষেই শুধু সম্ভব। আর সেই ঐতিহাসিক পটভূমি যদি হয়ে থাকে বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম প্রাণভোমরা স্বাধীনতার জন্য সেই অমর বাণী এবং রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ তাহলে তো এর শিল্পরূপ উপন্যাস যথাযথ ফুটিয়ে তোলা আরো দুরূহ। কারণ, পাঠক সমাজ তো এ বিষয়ে আগে থেকেই অনেক অবগত। সুতরাং শিল্পীর এক অগ্নিপরীক্ষা তো থেকেই যায়। আর এ জন্যেই তো মুক্তিযুদ্ধের সিকি শতাব্দী নয়, অর্ধশতাব্দীতে ও এসে শুনতে হচ্ছে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচিত হলেও এখনো শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মটি রচিত হয়েও ওঠেনি।
ইতিহাস থেকে যথাযথ উপাদান সংগ্রহ করা যেমন লেখকের দায়িত্বের মধ্যে পরে তেমনি বর্জনেও তাঁর অধিকার বিদ্যমান থাকে। তবে এক্ষেত্রে লেখককে পাঠকের চাওয়া-পাওয়ার দিকেও মনোযোগ রাখতে হয়। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। সাতই মার্চের বিকাল রচনায় হাত দিতে গিয়ে এসব বিষয়কে মনোযোগের সহিত অক্ষুণœ রাখার প্রাণান্তর চেষ্টা করেছেন। অবশ্য এ-ধাঁচের রচনায় তিনি আগেও হাতপাকিয়েছেন। তাঁর পনেরই আগস্টের কাল রাতের আর এক শৈল্পিক রূপায়ণÑ‘আগস্টের এক রাত (প্রকাশ-২০১৩) দু’টি উপন্যাসের পটভূমির বুননের ক্ষেত্রে লেখকের অখ- মনোযোগ বিদ্যমান। ইতিহাসের চরিত্রগুলো পাঠকের চেনা-জানা। তেমনি বাড়তি কোন রঙ ছাড়াই শিল্পিত উপস্থাপনায় উপন্যাসে স্থান করে নিয়েছে। ঐতিহাসিক চরিত্রের পাশা-পাশি অপরাপর ছোট ছোট চরিত্রগুলোও স্বল্পপরিসরে হলেও পটভূমির প্রয়োজনীয় তার স্থান পেয়েছে। উপন্যাসের ঐতিহাসিক সময়কাল নয় মাস মাত্র হলেও পটভূমি কিন্তু বিশাল। অসংখ্য ঘটনাবলী, রক্তক্ষয়ী শসন্ত্র সংগ্রাম এবং অসংখ্য চরিত্রের সমারোহে অনেক কিছু বলার অনুষঙ্গও রয়েছে। সে হিসেবে ‘সাতই মার্চের বিকাল’-এর উপাখ্যান আরো অনেক ব্যাপৃত হতে পারতো। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী। তবুও বলতে হয় কুশলী শিল্পী সেলিনা হোসেন স্বাধীনতার মহাকাব্যিক অমর বাণীকে উপন্যাসের আনুপূর্বিক পটভূমিতে ধারণ করে ইতিহাসকে এক শিল্পোত্তীর্ণ কথাসাহিত্যের রূপদান করেছেন।

শেয়ার করুন