চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জিপিএ ফাইভ নির্ভর সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি জাতিকে কী উপহার দিচ্ছে!

রোহিত চৌধুরী

৯ মার্চ, ২০২০ | ৩:৪০ পূর্বাহ্ণ

এখন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হয়েছে যে সব শিক্ষার্থীদের যে কোনো উপায়ে জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে তাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। অথচ জিপিএ ফাইভ না পেলে যে কোনো শিক্ষার্থী ভালো ছাত্র না এমন নয়। দেশের মোট শিক্ষার্থীর প্রতিবছর জিপিএ পায় মাত্র হাতে গোনা কয়েক হাজার ছাত্র। এর বাইরে অনেক ছাত্রই আছে যারা জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তদের চেয়েও ভালো তবুও শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই তারা কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না।
রতন কুমার তুরী
একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবনে ভালো ফলাফল করুক এটা সবাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু জীবন বাজি রেখে ঘুম, খাবার, তার প্রাত্যাহিক জীবনের সব কিছু ত্যাগ করে শুধুমাত্র জিপিএ ফাইভের পেছনে হন্য হয়ে ঘুরার মাঝে কি ধরনের শিক্ষা লুকিয়ে আছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থাই বা জাতির কী লাভ করছে বিজ্ঞ জনের ভেবে দেখেছেন কি?
একজন শিশু শিক্ষার্থী প্রথমে ঘুম থেকে ওঠেই এক গাদা বই নিয়ে স্কুলে যায় তারপর সে আবার কোচিং করে আবার এসে সে বাসার শিক্ষকের কাছে পড়তে বসে এক্ষেত্রে সে তার চিত্ত বিনোদনের জন্য কোনো সুযোগই পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতে সে তার মানসিক বিকাশ কতদূর ঘটাতে পারছে তা কেউ ভেবেও দেখছে না। যারা একটি অপূূর্ণাঙ্গ শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিশু কিংবা শিক্ষার্থীদের এমন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন তারা কি নিজেদের শৈশবের কথা একটি বার চিন্তা করেছেন? উন্নতদেশ সমূহে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার আগে তা মাঠ পর্যায়ে গভীরভাবে গবেষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে তা অনেক চিন্তা ভাবনা করে জনগণের ওপর প্রয়োগ করা হয় কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তার উল্টোটা ঘটে এখানে প্রথমে চাপিয়ে দেয়া হয় তারপর ধীরে ধীরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তা কাটছাট করা হয়। এতে জনগণও বিভ্রান্ত হয় সরকারেরও অর্থের অপচয় ঘটে। এর চেয়ে বরং সময় বেশি নিয়ে একটি যুগোপযোগী টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করলে জনগণও বিভ্রান্ত হতোনা, শিক্ষার্থীদেরও এমন অদ্ভুত জিপিএ ফাইভের পেছনে দৌঁড়াতে হতোনা। এখন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হয়েছে যে সব শিক্ষার্থীদের যে কোনো উপায়ে জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে তাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে।
অথচ জিপিএ ফাইভ না পেলে যে কোনো শিক্ষার্থী ভালো ছাত্র না এমন নয়। দেশের মোট শিক্ষার্থীর প্রতিবছর জিপিএ পায় মাত্র হাতে গোনা কয়েক হাজার ছাত্র। এর বাইরে অনেক ছাত্রই আছে যারা জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তদের চেয়েও ভালো তবুও শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই তারা কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে এক অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী শুধুমাত্র জিপিএ ফাইভ না পাওয়ার কারণে তাদের নিজেদেরকে মেধাবী ছাত্র নয় মনে করে শিক্ষা জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
প্রকৃতপক্ষে জিপিএ ফাইভ পদ্ধতিটিতে মেধার মূল্যায়ন কতটুকু হচ্ছে তা আমরা কেউ তলিয়ে দেখছি না। এমনও দেখা গেছে শিক্ষা জীবনে সব জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিজয় দিবস কোন তারিখ এবং স্বাধীনতা দিবস কোন তারিখ তাও জানে না। আবার অনেকেই এ দুটি দিবসের মধ্যে পার্থক্য কি তাও জানে না। তাহলে তার জিপিএ ফাইভ দেশের এবং তার ব্যক্তিগত জীবনে কি কাজে আসবে? প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয় শিক্ষাথীদের মননে, চিন্তায় মননশীল করার জন্য, আমাদের দেশের জিপিএ ফাইভ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা, তার কোনো কিছুই হচ্ছে বলে আমাদের মনে হয় না। এখন এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা খাতায় যা খুশি তাই লিখছে আর শিক্ষকরা সে লেখায় নাম্বার দিতে বাধ্য হচ্ছে। কোনো শিক্ষককের মতো জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ঠিক করেছে আবার কোনো শিক্ষকের মতে উদ্দিপকে যা-ই লিখুক নাম্বার দিতেই হবে। এইভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের নিয়মহীনতার নীতি সৃষ্টি হয়েছে এতে করে কিছু কম মেধাবী শিক্ষার্থী উতরে গেলেও মেধাবী শিক্ষার্থীরা চরমভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক সময় অন্যান্য বোর্ড থেকে জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য শিক্ষকরা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়। এতে করে উক্ত শিক্ষার্থীরা শিক্ষা জীবন শেষ করে বাংলাদেশের বিজয় দিবস এবং
স্বাধীননতা দিবস কোন তারিখ তাও বলতে পারে না। এমন কি ‘সে যায়’ এর ইংরেজি অনুবাদও করতে পারে না ফলে সবার মনে প্রশ্ন জাগে এই শিক্ষার্থীরা কীভাবে জিপিএ ফাইভ পেলো! মূলত জিপিএ ফাইভ নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মেধাবী করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের যে ধরনের পরিবেশ, পরিস্থিতি, অবকাঠামো এবং শিক্ষকদের দক্ষতা রয়েছে কিনা তা দীর্ঘদিন গবেষণার প্রয়োজন ছিল। এমন জিপিএ ফাইভ নির্ভর সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে হলে প্রথমে শিক্ষকদের বছরের পর বছর ট্রেইন আপ করা উচিত ছিল। এখন শিক্ষকদের মাত্র কয়েকদিনের ট্রেনিং দিয়ে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির মতো একটি বড় বিষয় শিক্ষা দেয়ার জন্য মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এতে করে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের তার নিজের মতো করে বুঝিয়ে গেলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এই পদ্ধতিতে তার পাঠ আত্মস্থ করতে সক্ষম হচ্ছে না। কিছু কিছু শিক্ষার্থী এতে সফল হলেও তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। আবার জিপিএ ফাইভের কবলে পড়ে অনেক শিক্ষার্থীরা শিক্ষা জীবনই মাঝ পথে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ কম তারপর আবার জিপিএ ফাইভের কবলে পড়ে অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বছরের পর বছর এই শিক্ষা পদ্ধতিতে আমাদের সন্তানরা জিপিএ ফাইভ নামক সোনার হরিণটির পেছনে দৌড়িয়ে গেলেও তা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে। একটি জাতির মেধা গঠনে আদৌ এমন জিপিএ ফাইভ নির্ভর সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োজন আছে কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমরা কি সত্যি সত্যি এ পদ্ধতির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মেধাবী করে তুলতে পারবো? নাকি আমাদের শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর এভাবেই জিপিএ ফাইভের পেছনে দৌড়াতেই থাকবে? এখন সময় এসেছে এ নিয়ে সকলের ভাবার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট