চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

দক্ষিণ এশিয়ায় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিস্তার রোধে মঈনুদ্দীন খান বাদলের উদ্যোগ

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

২৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের বাদল এবং ঢাকার বাদলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। চট্টগ্রামে নেতা হওয়া যত সহজ, ঢাকায় তত কঠিন। চট্টগ্রাম থেকে তাঁর সিনিয়র যা সমসাময়িক কোন নেতা ঢাকায় গিয়ে নেতা হতে পারেন নি। এইখানে বাদলের শ্রেষ্ঠত্ব। ক্রমান্বয়ে বাদল ভাই জাসদের কার্যকরী সভাপতি হলেন, এমপি হলেন এবং ১৪ দলের নেতা হলেন। বাদলের নেতৃত্বের গন্তব্য হয়তো আরো কিছু ছিলো কিন্তু মৃত্যু তাঁকে থামিয়ে দিলো। মৃত্যু বড়ো নির্মম এবং নিষ্ঠুর।

যখন যেখানে যে ফোরামে তিনি গিয়েছেন, অনেক তারার ভিড়ে হারিয়ে যান নি তিনি। এমপি হিসেবে পার্লামেন্ট কাঁপিয়েছেন তিনি ফ্লোর নিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করে। তাঁর মধ্যে যে একজন পার্লামেন্টারিয়ানের ক্ষমতা ছিলো, এমপি না হলে তা জানাই যেত না। যুক্তি, রেফারেন্স উদ্ধৃত করে তিনি জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করতেন পার্লামেন্টে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলতেন। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদের ওপর খড়গহস্ত ছিলেন। আর নিজের সাংসদীয় এলাকা বোয়ালখালীর কথা কখনো বিস্মৃত হতেন না। সুযোগ পেলেই সংসদে চান্দগাঁও-বোয়ালখালীর জনগণ, তাদের সমস্যা, অভাব-অভিযোগ তুলে ধরতেন আর কর্ণফুলীর ওপর বোয়ালখালী সেতু নির্মাণের জন্য গলা ফাটিয়ে সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন জানাতেন।

তিনি যখন ১৪ দলীয় কর্মীসভা বা জনসভায় বক্তৃতা করতেন, তখন তাঁর মধ্যে একজন জাতীয় নেতার প্রতিচ্ছবিই খুঁজে পাওয়া যেত। দেশ ও জাতির কথা মাথায় রেখেই দায়িত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন। কখনো হাল্কা রসিকতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের তীক্ষè হুল ফুটিয়ে, কখনো বা গুরুগম্ভীর, কখনো উদাত্ত কণ্ঠে-মোট কথা ভাব অনুযায়ী, বক্তব্য-বিষয়ের আলোকে যখন যেভাবে প্রয়োজন, স্বরক্ষেপণ করে যে বক্তৃত্য করতেন, সেটা দর্শক-শ্রোতাগণকে উজ্জীবিত-উদ্দীপিত করতো।

জাসদের সাংগঠনিক কাঠামোতে সিনিয়র আম্বিয়া ভাইর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে সভাপতির পদে বৃত করে তিনি কার্যকরী সভাপতি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সবাই জানতো জাসদের এক নম্বর বা মূল নেতা তিনিই। ঢাকায় বিভিন্ন সভা-সমিতি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং পার্লামেন্টে তাঁর যুক্তিপূর্ণ, তথ্যবহুল জ্ঞানগর্ভ ভাষণ প্রদানের ফল হয়েছিলো এই- টিভি চ্যানেলগুলির টক শোর অ্যাংকরদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় তাঁর প্রতি। অতঃপর টিভি চ্যানেলের টক শোতে তাঁর সারগর্ভ বক্তব্য উপস্থাপনের ফলে সারাদেশের মানুষ তাঁর টক শো শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী পড়ে, দেশ-বিদেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে, জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ওঠাবসা, বিভিন্ন দলীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে দেশ ও দলের প্রতিনিধিত্ব করে তিনি একজন আলোকিত মানুষ, জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন।

বিশ্ব পরিসরেও বাদল ভাই’র বিচরণ ছিলো। দক্ষিণ এশিয়া তথা উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার বলিষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন তিনি।

বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও সমরসজ্জার বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র প্রতিবাদী বক্তব্য দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিবাদী ও মানবতাবাদী নাগরিক সমাজের মধ্যে গভীর আশাবাদ, আগ্রহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিলো। তিনি ‘বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান পিপলস ফোরাম’ নামে ত্রিদেশীয় একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার সঙ্গে তিন দেশের বিবেকবান, যুক্তিবাদী, গণতান্ত্রিক ও মানবিক সংস্কৃতির অনুরাগী মানুষগুলো জড়িত হয়েছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পালা করে এই সংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। এ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লকের জেনারেল সেক্রেটারি দেবব্রত বিশ্বাস এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাদল ভাই। সংগঠনটির সাতটি সম্মেলন হয়েছিলো-দু’বার বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামে এবং পাঁচবার ভারতে। সেদেশের পশ্চিম বঙ্গের নদীয়ায় একবার ও কলকাতায় দু’বার, দিল্লি ও পাঞ্জাবে একবার করে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৩ অক্টোবর কলকাতার কমরেড নলিনী গুহ মিলনায়তনে এই সংগঠনের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাদল ভাই অসুস্থ শরীর নিয়ে উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন এবং তাঁকেই আবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। সম্মেলন শেষ করে তিনি ব্যাঙ্গালোরে যান চেক-আপের জন্য। সেখান থেকে আর জীবিত ফিরে আসতে পারলেন না।

তাঁর একটি স্বপ্ন ছিলো শহরের সঙ্গে বোয়ালখালীর জনগণের যাতায়াত সুগম করার জন্য কর্ণফুলী নদীর ওপর আর একটি সেতু প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৩০ সালে নির্মিত কালুরঘাট সেতু সময়ের বিবর্তনে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিলো। সেটি ছিলো মূলত রেলসেতু। দোহাজারি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনে তৈরি ওই সেতুর ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কও নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেটি ঠিক বোয়ালখালী সেতু নয়। শাহ আমানত সড়ক সেতু হওয়ার পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগের জন্য কালুরঘাট সেতুর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। পটিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এবং কক্সবাজার জেলার যানবাহনগুলো শাহ আমানত সেতু দিয়েই চলাচল আরম্ভ করে। বোয়ালখালী একপাশে পড়ে যাওয়ায় বোয়ালখালীর মানুষ শাহ আমানত সেতুর সুবিধা থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি কালুরঘাট সেতুও বোয়ালখালীর মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারছেনা। এই পরিস্থিতিতে বোয়ালখালীর সাংসদ হিসেবে বাদল ভাই কর্ণফুলীর ওপর বোয়ালখালী সেতু নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। তিনি পার্লামেন্টেও বিভিন্ন সময়ে কালুরঘাট সেতুর প্রয়োজন তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। তিনি এই সেতু নির্মাণের দাবিতে বোয়ালখালীর মানুষকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন, জনসভা এবং মিছিল করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নটি পূরণ হলো না।

তিনি বোয়ালখালী সেতু দেখে যেতে পারলেন না। বোয়ালখালী সেতু না হলে হয়তো তাঁর আত্মাও শান্তি পাবে না।

ব্যক্তিগত তথ্য : মরহুম মঈনুদ্দিন খান বাদল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আহমদ উল্লাহ খান পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং এসপি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। জনাব বাদলের চার ভাই ও তিন বোন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ডিগ্রি নিয়েছিলেন।

তাঁর সহধর্মিনীর নাম সেলিনা বাদল। তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা ছিলেন। বাদল ভাইয়ের সঙ্গে যাঁরা রাজনীতি করেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই লিখতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী সাথী দাশ, নাওজীশ মাহমুদ, আবু জাফর মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল মাবুদ-এঁরা প্রত্যেকেই লেখার ক্ষমতা রাখেন। একদা বাদল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী প্রিয়সখা সুশীল বড়–য়া এখন বিএনপি করলেও তিনিও বাদল ভাইয়ের অবিচুয়ারি লিখলে কোন ক্ষতি ছিলো না। কিন্তু তাঁরা কেউ লিখলেন না। কেন আমি জানি না। তাঁরা না লেখায় আমাকে কলম ধরতে হলো। বাদল ভাইয়ের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছি কিনা, সেটা জাসদের নেতা-কর্মীরাই বলবেন। যদি না পেরে থাকি সেটা ইচ্ছাকৃত নয়, আমার অজ্ঞতা বা অক্ষমতা ধরে নিয়ে আমাকে মার্জনা করার জন্য করজোড়ে মিনতি করছি। ­

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট