চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

একুশে : সত্যের সঙ্গীতের পেছনে ছুটে চলা

সমকাল দর্পণ

ড. মাহফুজ পারভেজ

২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ২:৩২ পূর্বাহ্ণ

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির সংগ্রামমুখর ঘটনাটি ৬৮ বছর স্পর্শ করলো এ বছর (২০২০)। তবে, বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আরও প্রাচীন। পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনাতেই অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলায় বঙ্গ প্রদেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদগণ বাংলার পক্ষে কথা বলেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই শাসকরা চেয়েছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে আর বাঙালিরা ফুঁঁসছিল প্রতিবাদে, যার রক্তাক্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে।
১৯৪৭ সালে যে ভূখ-গুলো নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায়, তার কোথাও মানুষের ভাষা উর্দু ছিলনা। পাকিস্তানে সমগ্র পূর্বাঞ্চল, যা আজকের বাংলাদেশ, সেখানে সমগ্র জনতার প্রধান ও একমাত্র ভাষা ছিল বাংলা।

পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে ছিল চারটি প্রদেশ, সেখানেও উর্দুর অস্তিত্ব ছিলনা। পাঞ্জাব প্রদেশের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি। সিন্ধুতে সিন্ধি। বেলুচিস্তানে বেলুচ আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পশতু। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যে ভূখ-গুলোকে নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সেখানকার মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে পাকিস্তান চায়নি এবং কোথাও পাকিস্তান দাবির সমর্থক মুসলিম লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার ছিলনা।
বাংলায় ছিল তিনটি মত। এক, অখ- বাংলার পক্ষে সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসেম, শরৎ বসুর গ্রুপ। দুই. হিন্দু বাংলার পক্ষে শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা এবং তিন. পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ।
পাঞ্জাব শাসন করছিল সেকান্দার হায়াত খানের ইউনিয়নিস্ট পার্টি। সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল গাফফার খান ছিলেন সায়ত্তশাসনের পক্ষে। বেলুচিস্তান ছিল কালাত নামের দেশীয় স্বাধীন রাষ্ট্র। সিন্ধুতে কংগ্রেসের একজন এমপিকে করাচির রাস্তায় রিকসা দিয়ে যাওয়ার সময় গুলি করে হত্যার মাধ্যমে প্রাদেশিক সংসদে অতি কষ্টে ভোটে জেতে পাকিস্তানপন্থীরা।

এহেন পাকিস্তানের প্রধান দাবিদার ছিল উত্তর প্রদেশ, বিহারের উর্দুভাষীরা। পাকিস্তানের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সরব ছিল তারা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর মাধ্যমে বলীয়ান হয়ে তারাই সব ক্ষমতা দখল করে। ভারতের উর্দুওয়ালা কেরানি পাকিস্তানে এসে সচিব হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় বা সরকারি ভাষা উর্দু হওয়ার সুবিধা নিয়ে এরাই রাজনীতি, সরকার ও প্রশাসন দখল করে।
বাংলা এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সবচেয়ে আগে ধরতে পারে ও প্রতিবাদমুখর হয়। উত্তর ভারতের উর্দুওয়ালারা যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মাথায় বসেছে অন্যদেরকে অবদমিত করে, এই সত্য ও বাস্তবতা বাঙালি সবচেয়ে আগে বুঝতে পেরেছে বলেই আন্দোলন-সংগ্রাম করে স্বাধীন হতে পেরেছে।
পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলো তা অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অবনমিত হয়ে রয়েছে। সিন্ধুতে এখন সিন্ধি ভাষার অস্তিত্ব নেই। পাঞ্জাবের লোকজন পাঞ্জাবি ত্যাগ করে উর্দুভাষীতে পরিণত হয়েছে। বেলুচ ও পশতু ভাষার অবস্থাও শোচনীয়। বেলুচরা স্বাধীনতার দাবিতে এখনও লড়ছেন। পাঠানরাও স্বকীয়তা রক্ষার্থে প্রায়ই স্বাধীন পাখতুনিস্তানের ডাক দেন।
উত্তর ভারতের উর্দুভাষী মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাকে সফল করতে ধর্মকে ব্যবহার করে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে, তার সর্বাংগে শত শত অসংগতি। ধর্ম সেখানে নিরাপদ নয়। ধর্মের নামে প্রতিদিন খুন-জখম-রক্তপাত হচ্ছে সেখানে। গণতন্ত্রের ন্যূনতম অধিকার নেই মানুষের। উন্নয়নের সুষম বিন্যাসের বদলে সেখানে চলছে লুটপাট। সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদগণ আর মোল্লারা অর্থ, শক্তি ও ক্ষমতার বলে সমগ্র জনতাকে প্রতিনিয়ত পদদলিত করছে পাকিস্তানে।

পাকিস্তানের এই বিপর্যয় ও শোচনীয় অবস্থা আগাম দেখতে পেয়েছিলেন উপমহাদেশের অগ্রসর ও বিচক্ষণ জনগোষ্ঠী বাঙালিরা। একুশের অনির্বাণ চেতনায় সাংস্কৃতিক অধিকার আদায় করে স্বাধীনতার মোহন স্পর্শ পাওয়া তাই সংগ্রামী বাঙালির পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। উপমহাদেশের অন্য কোনও জাতিগোষ্ঠী এই সংগ্রামশীলতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখাতে পারেনি বলে এখনও অবদমিত ও নিগৃহীত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলা ও বাঙালিরা রাজনৈতিক সারসত্যের নিগূঢ়তম বাস্তবতা সর্বাগ্রে ও যোগ্যতার সাথে আত্মস্থ করার উজ্জ্বলতম জনগোষ্ঠীর গৌরবময় দৃষ্টান্ত।
এজন্যই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতায় চেতনাদীপ্ত বাঙালিরা হলো এমন এক অনন্য জনসমষ্টি, যা বাংলাদেশের ক্রম-অগ্রগতিতে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত। স্বাধীন বাংলাদেশ এখন শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, সময় বিশ্বের মধ্যে উন্নয়ন, অগ্রগতির আলোকিত ও অনুসরণযোগ্য মডেল। পাকিস্তান ও আরও অনেক দেশ এখন বাংলাদেশের অগ্রসরতাকে অনুসরণ করে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশের যাবতীয় অর্জনের পেছনে প্রধানতম অনুপ্রেরণার উৎস একুশের ভাষা আন্দোলন। একুশের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক বিকাশের স্বপ্নকে সফল করেছে। একুশ শিখিয়েছে মাথা নত না করতে।
একুশ সেই বায়ান্ন সালেই ধর্মের বিকৃতি ও ভাষার আগ্রাসনমূলক ষড়যন্ত্রের নীল নকশার ভিত্তিতে পাকিস্তানের নামে তৈরি হওয়া ভুল-রাজনীতিকে ছিন্ন করেছে এবং ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভিত্তিতে গড়ে উঠা শোষণ-নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক-স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক আধিপত্যকে ‘না’ বলে গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করেছে।

একুশের এই চেতনাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রসরতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক গতিশীলতার চালিকা শক্তি। সত্যের সঙ্গীতের পেছনে ছুটে চলার এমনই এক সুরধ্বনি সৃষ্টি করেছে একুশে, যা বাংলাদেশকে করেছে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, উদারতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও উন্নয়নের পথে অবিচল ও অকুতোভয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ কবি-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট