চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

বন্ধ হয়নি সরকারি গুদাম থেকে চাল পাচার

পাহাড়তলীর ফারুক ট্রেডার্সের গুদাম থেকে উদ্ধার হলো ২১ বস্তা ত্রাণের চাল

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১১ এপ্রিল, ২০২০ | ৩:০০ পূর্বাহ্ণ

খাদ্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গুদাম থেকে সরকারি ত্রাণের চাল অনায়াসে চলে যাচ্ছে খোলা বাজারে। দীর্ঘদিন ধরে ‘ডিও’ বাণিজ্যের অন্তরালে খাদ্য বিভাগের বিনামূল্যের চাল নিয়ে চলছে চালবাজি। ২০১৭ সালে হালিশহর সিএসডি খাদ্য গুদাম থেকে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ চালসহ দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। এরপর সরকারি গুদাম থেকে চাল পাচার বন্ধ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি খাদ্য গুদাম থেকে ডিও’র অন্তরালে পাচার হয় সরকারি চাল। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় গুদাম দুটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগের অন্ত ছিল না। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। ত্রাণের চাল বস্তা পাল্টিয়ে খোলা বাজারে বিক্রির বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নঈম মো. শফিউল আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি তিনি। মুঠোফোনে এসএমএস পাঠানোর পরও তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের মোবাইলে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি তিনিও। তবে দুই খাদ্য গুদামের বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে চাল যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তা আমাদের জানা থাকে। দেওয়ানহাট সিএসডি গুদামের ম্যানেজার চন্দ্র শেখর মল্লিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।’ কমিটির প্রধান সহকারী জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রূপান্তর চাকমা পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমাদের সর্বশেষ নির্দেশনা ছিল, গুদাম থেকে চাল সরবরাহের সময় একটি সিল দেওয়া থাকবে। সরবরাহের তারিখ ও সিল ছিল না। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এগুলো পুরোনো চাল। কোথায় থেকে এসেছে তা জানা যায়নি।’ গত বুধবার ডবলমুরিং থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে পাহাড়তলী বাজারের চাল ব্যবসায়ী মেসার্স ফারুক ট্রেডার্সের গুদাম থেকে ২১ বস্তা সরকারি ত্রাণের চাল উদ্ধার করেছে। এছাড়াও ১৫শ খালি বস্তা এবং ৯ হাজার চটের বস্তা উদ্ধার করেছে। সরকারি চাল নুরজাহান ব্যান্ডের বস্তায় ভরে বাজারজাত করার সময় তা জব্দ করেছে পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, খাদ্য বিভাগের সহায়তা সরকারি বিপুল পরিমাণ চাল খোলা বাজারে পাচার করা হয়। খাদ্য বিভাগের মৌন সম্মতিতে দীর্ঘদিন ধরে এই অবৈধ কার্যক্রম চলে আসছে।
২০১৭ সালে হালিশহর সিএসডি গুদাম খোলা বাজারে চাল পাচারকালে বিপুল পরিমাণ চাল জব্দ করেছিল র‌্যাব। এই ঘটনায় ৭ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। মামলায় খাদ্য বিভাগের দুই কর্মকর্তা, পাহাড়তলী-খাতুনগঞ্জের দুই ব্যবসায়ী ও ট্রাকচালকসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলার পাহাড়তলী চাল বাজারের খাজা ভান্ডারের শাহাবুদ্দিন এবং খাদ্য বিভাগের দুই কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম ও প্রণয়ন চাকমাকে আসামি করা হয়েছিল। মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে। এর একদিন আগে আকবরশাহ থানা পুলিশও বিপুল পরিমাণ সরকার চাল জব্দ করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাল পাচার হয়ে আসলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য বিভাগ।
হালিশহর সিএসডি গুদামের ম্যানেজার থোয়াই প্রু মারর্মার কাছে জানতে চাইলে তিনি উল্টো এই প্রতিবেদকের কাছে চাল আটকের বিষয়ে জানতে চান। সরকারি ত্রাণের চাল আটক হয়েছে অথচ খাদ্য বিভাগ জানে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘সরকারি বরাদ্দের অনুকূলে ত্রাণ, খয়রাতিসহ বিভিন্ন এই গুদাম থেকে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হয়। এসব চাল কোথায় যায় আমাদের আর জানা থাকে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যোগদান করার আগে চাল পাচারের ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি।
করোনাভাইরাস আতঙ্কের পর চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এতে সরকার খাদ্যবান্ধব বিভিন্ন প্রকল্পও গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ১০ টাকার চাল বিক্রি কর্মসূচি নিয়েছে। এসব চাল এখন খোলা বাজারে পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। খাদ্য গুদামের হ্যান্ডলিং ঠিকাদার ও খাদ্য পরিবহন ঠিকাদারের আঁতাতে সরকারি চাল খোলা বাজারে চলে আসছে বলে একাধিক সূত্র জানায়। বিশেষ করে ‘ডিও’ ব্যবসার আড়ালে সরকারি খাদ্য গুদামের চাল নিয়ে কারসাজি করে আসছে শীর্ষ দুই চাল ব্যবসায়ী। এরমধ্যে ফারুক ট্রেডিংয়ের চাল পাচারের বিষয়টি ধরা পড়েছে। আসামি হচ্ছেন ফারুক ট্রেডিংয়ের মালিক মো. ওমর ফারুক ও দুই কর্মচারী। দুই কর্মচারীকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পাহাড়তলী বাজারের চাল ব্যবসায়ী ও খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদার মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমরা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কাপ্তাই থেকে দ্বিতীয়পক্ষের মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর চাল কিনে ব্যবসা করছি।’
ডবলমুরিং থানার ওসি (তদন্ত) মো. জহির উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘সরকারি খাদ্য বিভাগের চালের বস্তা পাল্টানোর সময় ফারুক ট্রেডিংয়ের গুদাম থেকে ১৫শ খালি বস্তা এবং ২১ বস্তা চাল উদ্ধারের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ফারুক ট্রেডিংয়ের মালিক ওমর ফারুককে আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও গ্রেপ্তারকৃত দুই কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট